বিপ্লব বড়ুয়া

  ২৬ মার্চ, ২০২৪

বিশ্লেষণ

বাঙালির রক্তে অর্জিত ৩০ লাখ শহীদের দেশ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত এবং ২৬ মার্চ সমস্ত বাঙালির জীবনে এক বেদনাবিধুর ভারাক্রান্ত ইতিহাসের নির্মম সময়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ছক আঁকতে শুরু করে সেই ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে। রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বাঙালির যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল, তা কোনোভাবে পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একের পর এক সংগঠিত হতে দেখে পাকিস্তানিরা নানাভাবে নির্যাতনের খড়গের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় নিরীহ বাঙালির ওপর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাঙালিদের জীবন যে কী পরিমাণ দুর্বিষহ ছিল, তা এক কথায় অবর্ণনীয়। পাকিস্তানিরা কী রকম নরপশু ছিল, সেই ইতিহাসের কথা ভাবলে বাংলার স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের হৃদয়ে এখনো রীতিমতো ক্ষোভ ও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। কারণ পৃথিবীব্যাপী এমন নজির নেই প্রিয় স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষ শহীদ ও ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি হয়েছে।

যেভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, সামরিক ও বেসামরিক লোকরা বাঙালিদের জানমালের ওপর নৃশংসভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, ব্রিটিশরা কেন পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ মানুষ হয়ে মানুষের ওপর ধ্বংসলীলা চালিয়েছে বিশ্বে এমন নজির আছে বলে আমার জানা নেই। এক শ দুই শ নয়, এক হাজার দুই হাজার নয়, দশ হাজার বিশ হাজার নয়, এক লাখ দুই লাখ নয়, পাঁচ লাখ দশ লাখ নয়, ত্রিশ লাখ অর্থাৎ অঙ্কে যদি লিখি ৩০-এর পরে আরো পাঁচটি শূন্য যোগ করলে ৩০ লাখ লেখা হয়। তার সঙ্গে নারীদের জীবন ধ্বংস হয় চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার নয়, দুই লাখ। দুয়ের পরে আরো পাঁচটি শূন্য যুক্ত করলে দাঁড়ায় দুই লাখ। আমি নিজেও এত বছর এই অঙ্কটিকে এই ভেবে কষে দেখিনি। মুখের ওপর এই অঙ্কটা বক্তৃতাবাজিতে অতি সহজে বলে ফেলতাম। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া আর ফিলিস্তিনির ওপর ইসরায়েল প্রতিদিন যে তাণ্ডব চালাচ্ছে, সেটি দেখে যখন প্রতিদিন লাশের বহর গুনি (ইসরায়েলে এ পর্যন্ত ৩১ হাজার লোকের মৃত্যুর খবর আর ইউক্রেনে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩১ হাজার সেনা মৃত্যুবরণ করেছে আর বেসামরিক মানুষ মারা গেছে প্রায় ১২ হাজারেরও অধিক) এই এতসংখ্যক মৃত্যু নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যখন উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছি, এ অবস্থা দেখে তখন একবার ফিরে তাকালাম সেই অতীতের দিকে আমাদের স্বাধীনতা পাওয়ার চিত্রটি যে কত দুঃসাধ্য, ভয়ংকর ছিল ভাবতে সত্যিই বিস্ময় জাগে।

২৫ মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে সেদিন গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যায়। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-কুলি-কামার সব বাঙালি একত্র হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে সামরিক সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তার নাম দেওয়া হয় অপারেশন সার্চলাইট। দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি।

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অপরাগত প্রকাশ করার কারণে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দেখা দেয়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা। এমন একটি সময়ে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা করে ধ্বংসের পথ বেছে নেয়। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। তখন নিরীহ বাঙালিদের ওপর এই বর্বরোচিত হামলার দৃশ্য বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছিল। কীভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা গণহারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। মধ্যযুগীয় কায়দায় হানাদাররা রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা ঢাকা শহরে চালায় হত্যাযজ্ঞ, করে অগ্নিসংযোগ। এই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান।

২৫ মার্চের কালরাতের বেদনাদায়ক ঘটনা সমগ্র জাতিকে শিহরিত করে। নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেও সেদিন মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করা যায়নি। ভয়াবহ সেই কালরাতের হত্যাযজ্ঞ বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিল। পাক হানাদার বাহিনী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলার নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। রাত ১টা নাগাদ পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টারে ১৮ জন বাঙালি গার্ড থাকলেও তারা পাল্টা আক্রমণ করতে ব্যর্থ হয়। পিলখানা আক্রমণের পাশাপাশি রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারীবাজারসহ ঢাকা জুড়ে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ। বিভিন্ন এলাকায় যথেচ্ছ হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে চলে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। রাত দেড়টায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধের বহর ভেঙে হানাদাররা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে পৌঁছে যায়। হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে। বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবন থেকে বন্দি করে শেরেবাংলা নগরের সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর কানে পৌঁছে ছিল। ইয়াহিয়া খানের ছলচাতুরী দেখে রাত ৯টার পর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মার্কিন সাঁঝোয়া ট্যাংক, সঙ্গে সেনা বোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা। শহীদ হন কয়েক শ ছাত্রছাত্রী। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের ৯ শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে গুলি ছুড়ে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করে অজস্র নিরাপরাদ সাধারণ মানুষদের। রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই। ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো সদর দপ্তর।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়্যারলেস বার্তায় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতাণ্ডপুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’ পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এ বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজ এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন।

বাঙালির স্বাধীনতা পাওয়া ছিল খুব দুঃখের কষ্টের। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে সেদিন যারা নিষ্ঠুরভাবে মরণপণ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল, তারা বাঙালির স্বপ্ন সাধনার অগ্নিসন্তান। সেই বীর সন্তানদের জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close