মাজহার মান্নান

  ২৫ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শিক্ষাঙ্গনে নীরব কান্না ক্ষত কত গভীরে

উচ্চশিক্ষায় নানা বিশৃঙ্খলা আমরা লক্ষ করি। কিন্তু দিনে দিনে সেটা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এক নব দানবীয় রূপ লাভ করেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিশেষ ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে চৌর্যবৃত্তির স্তরে নামিয়ে এনে তারা কী বার্তা দিচ্ছেন। ব্যক্তিগত লালসার শিকার বানিয়ে মহাদাপটে তারা কী করে ঘুরে বেড়ান। কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা কতটুকু সত্য বা কতটুকু মিথ্যা তা তথ্য, উপাত্ত ও তদন্তসাপেক্ষে জানা যায়।

আমার প্রশ্ন হলো- শিক্ষকদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? রক্ষক কেন ভক্ষকের ভূমিকায় যাবে? ১৫-২০ বছর আগে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অবক্ষয়ের চিত্র দেখা যায়নি। তবে এখন কেন সীমা অতিক্রম করছে? রোগটা আসলে শনাক্ত করা দরকার। রোগ শনাক্ত হলেই তো ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- তরকারি কুটায় দোষ থাকলে রান্নায় সেটা সারে না। কিং লেয়ার নাটকে শেক্সপিয়ার বললেন, নাথিং কামস আউট ফরম নাথিং (শূন্য থেকে শূন্যই আসে)। বাবা-চাচারা বলতেন, বীজ ভালো তার ফল ভালো। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো এই প্রবাদ প্রবচনগুলো এসেছে।

কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন? একটা সময় ছিল যারা বিভাগে সর্বোচ্চ মেধাবী থাকতেন এবং নৈতিক চরিত্রের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন, তারা কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই নিয়োগ পেতেন। তারা আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতেন। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? নিয়োগের প্রধানতম পূর্ব শর্ত হয়ে গেছে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ আর রাজনৈতিক বিবেচনা। নিয়োগেই যখন দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে, তখন তাদের কাছ থেকে কীভাবে ভালো কিছু আশা করা যায়? ক্ষমতার দাপটে যখন নিয়োগ বিজয় হয়ে যায়, তখন অন্যকে পদপিষ্ট করা খুব একটা বিবেকে বাধার কথা নয়। ব্যক্তিগত ভোগ-লালসা মেটানোও তখন খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

গত কয়েক বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের যৌন নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো আলোচনা করতে গেলে কলেবর বেড়ে যাবে। তাই সেদিকে না গিয়ে অবন্তিকার আত্মহত্যার দিকেই নজর দিতে চাই। প্রতিটি মানুষ তার স্বীয়সত্তা নিয়ে বড় হয়। নারীসত্তা অনেক সূক্ষ্ম হয়ে থাকে। মুখ বুজে নারীরা অনেক কিছু সহ্য করলেও তাদের প্রতিবাদী সত্তা জাগ্রত থাকে। পুরুষশাসিত সমাজে হয়তো তাদের সেই প্রতিবাদী রূপটি পূর্ণতা পায় না। পুরুষের শোষণের মাত্রা যখন সীমা ছাড়ায়, তখন নারী প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু যখন সে দেখে তার প্রতিবাদ প্রস্ফুটিত হবে না, তখন সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম তার আত্মহত্যা মতবাদে দেখান যে, একজন মানুষ যখন তার প্রতিবাদী সত্তাকে সমাজে ঠাঁই করাতে পারে না, তখন সে আত্মহত্যা করে। অবন্তিকা হয়তো প্রতিবাদ করে জয়ী হতে চেয়েছিল। কিন্তু সে হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি যে এ সমাজ এখনো পশুত্বমুক্ত হয়নি। সে বলদের কাছে দুধের ভিক্ষা চেয়েছে, তাই সে দুধ পায়নি। যাদের কাছে সে বিচার চেয়েছে তারা তাকে বিচারের পরিবর্তে হয়তো তিরস্কার দিয়েছে, যেটা অবন্তিকার সহ্য করা কঠিন ছিল। ফেসবুকে আরেক মেয়ের আর্তনাদ দেখলাম। তাকে কীভাবে পরতে পরতে হেনস্তা করা হচ্ছে। সাবলীল বাচনভঙ্গিতে সে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছে। শিক্ষকতা নামক মহান পেশাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা? অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন? কার ভরসায় মেয়েরা নিরাপদ থাকবে? অঘটন ঘটার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কিন্তু সেটা কি যথেষ্ট? তবে একটি বিষয় বলতে চাই জোর গলায়, অনেক সময় শিক্ষকরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে থাকেন। কোনোভাবেই যখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় না, তখন নারীকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ এবং নিখুঁত তদন্ত হওয়া দরকার পড়ে।

কিন্তু দেশের তদন্তব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা কতটুকু? যে রোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে, সেটার শেকড় খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই চরিত্রকে সর্বপ্রথম প্রাধান্য দিতে হবে। কিছু দিন আগে ভিকারুননিসায় যা হলো তাতে শিক্ষক হিসেবে খুব লজ্জিত হয়েছি। আমার এই কলামটি হয়তো যাদের নজরে আসার দরকার, তাদের নজরে নাও আসতে পারে। তবু প্রতিবাদী কলম চলতে থাকবে। অবন্তিকার বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

শিক্ষকদের মধ্যে দলীয়করণ, রেষারেষি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে এটার লাগাম টেনে ধরা এখন সুকঠিন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ এবং শিক্ষক নিয়োগের সংস্কৃতি কতটুকু লাভবান করেছে, উচ্চশিক্ষার পরিবেশকে তা বিজ্ঞজনরাই ভালো বলতে পারবেন। অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক রাজনীতির কারণে বলির পাঁঠা হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কারণে অস্থির হয়ে উঠলে শিক্ষক রাজনীতির ছদ্ম রূপটি আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ব্যক্তিস্বার্থ বড়, নাকি সামগ্রিক স্বার্থ? বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের অস্থিরতার পেছনে একক কোনো কারণ থাকে না। তবে শিক্ষকদের দলীয়করণ এবং রেষারেষি একটি অন্যতম কারণ, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ এবং স্বজনপ্রীতি যখন চরমে তখন এ ধরনের অস্থিরতাই নিত্য হয়ে ওঠে।

কোথায় যাচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ? এভাবেই কি চলতে থাকবে। এর শেষ কোথায়? উপাচার্য ফরিদ আহমেদ দুই মেয়াদে আছেন। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফেরানোর জন্য তাকে যদি পদত্যাগ করতে হয়, তবে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে তার সেটাই করা উচিত। আমাদের দেশে কারো বিরুদ্ধে যদি পদত্যাগের দাবি ওঠে, তবে তিনি তা সহজে করতে চান না। তিনি এটাকে পরাজয় এবং অসম্মানের মনে করেন। কিন্তু পদত্যাগের মধ্যেও যে এক ধরনের ডাইনামিক ব্যক্তিত্ব কাজ করতে পারে, তারা সেটা ভুলে যান। পদত্যাগের মাধ্যমেও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, কেননা যিনি একবার ক্ষমতায় যান তিনি এমনভাবে মনোপলিক হয়ে ওঠেন, পদত্যাগ করতে তিনি ভয় পান। পদত্যাগের মাঝেও যে গৌরব লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা উপলব্ধির বিষয়, যা হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তবয়স্ক। তাদের বোঝার ক্ষমতা আছে যেকোনো বিষয়। অন্যের স্বার্থের কাছে তারা ধরা দিলে তাদের ক্যারিয়ার নষ্ট হতে পারে এই বোধটুকু তাদের থাকতে হবে। কেন তারা অন্যের হাতিয়ার হয়ে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবে, এই চিন্তা তাদের করতে হবে। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে দেশ গঠনে মনোযোগ দেবে, কারো হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তারা বলির পাঁঠা হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেকোনো মূল্যেই হোক শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে, অন্যথায় চরম মূল্য দিতে হবে জাতিকে। ব্যক্তিস্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থকে বড় করে না দেখে দেশপ্রেমের শিক্ষায় আলোকিত হতে হবে শিক্ষার্থীদের।

লেখক : শিক্ষক, কবি ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close