মো. খসরু চৌধুরী

  ০৭ মার্চ, ২০২৪

মতামত

বাঙালির স্বাধীনতা ও গৌরব গাঁথার মাস মার্চ

শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতা ও গৌরব গাঁথার মার্চ মাস। এই মাসের ২৫ তারিখ থেকে লেখা শুরু হয়েছিল এক অমর মহাকাব্য, যার নাম বাংলাদেশ। বাঙালির জীবনে ভাষা আন্দোলনের স্মারক মাস ফেব্রুয়ারির পর মার্চের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয় এই মার্চেই।

এই মাসেই বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। উত্তাল একাত্তরে পুরো মার্চ মাস বাঙালির চোখে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের সাধারণ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। মুহূর্তে গর্জে ওঠে পুরো দেশ। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ স্লোগান তোলে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।

মার্চ মাসেই বাঙালি জাতি তার চেতনাকে নতুন করে শানিত করে। নতুন শপথে বলীয়ান হয়। অত্যাচার, নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্মারক মাস হিসেবে মার্চ প্রতিবারই আমাদের নতুন করে পথ দেখায়। আমরা আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই বীর শহীদদের, যারা স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের মূল্যবান জীবনদান করে প্রতিরোধ সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান তথা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রচিত হয়েছিল অনন্য এক কবিতা। সর্বকালের সেরা বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইতিহাসের বৃহত্তম জনসমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন তার সেই অমর পঙ্ক্তি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু দৃঢ় প্রত্যয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিনি যদি নির্দেশ দিতে নাও পারেন, তবে আক্রান্ত হলে বাঙালিরা যেন যার কাছে যা আছে তা নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে ভাষণ দেন জাতিসংঘের স্বীকৃতি অনুযায়ী তা দুনিয়ার সেরা ভাষণগুলোর একটি। চলতি বছর থেকে ৭ মার্চ প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় জাতীয় পতাকা উড্ডীন করা হচ্ছে। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ৭ মার্চ দিনটি মাইলফলকের ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে ভারতবর্ষ ভেঙে প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ১২০০ মাইলের ব্যবধানে দুটি ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পাকিস্তানে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনামলে সর্বক্ষেত্রে বাঙালিদের বঞ্চিত ও শোষিত করার ঘৃণ্য ইতিহাস রচিত হয়। এর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব রুখে দাঁড়ায় বাঙালিরা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। কিন্তু বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রতিহত করতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেও স্থগিত করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানও ঘোষিত হয়েছে ভাষণে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একাত্তরের ৭ মার্চ একটি মাইলফলক। একাত্তরের উত্তাল ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ শুধু উপমহাদেশই নয় পুরো বিশ্ব পরিসরে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ (বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ছাড়াও বিশ্বনেতা, বুদ্ধিজীবীরা এ ভাষণ সম্পর্কে তাদের বিশ্লেষণ ও বিশ্বরাজনীতিতে তার প্রভাব ও প্রয়োগ নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন।

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল।’

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যত দিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, তত দিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’

কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন, ‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি ও বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থক। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’

যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট যোশেফ মার্শাল টিটো বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনো রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা।’

অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছিলেন মানবজাতির পথ প্রদর্শক। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র পৃথিবীও স্বীকার করবে।’

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধু যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন। শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশও ঘোষিত হয় তার বজ্রকণ্ঠে। পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতি স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। এ দেশের তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা সেদিন এই একটি কণ্ঠের মন্ত্রমুগ্ধে আবিষ্ট হয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যার যার মতো করে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। স্বাধীনতা এবং মুক্তির ঐকতানে এক হয় জাতি। এরই মধ্যে নানা কূটকৌশল চালাতে থাকে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও শাসকগোষ্ঠী। প্রথমেই তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে করতে থাকে সময়ক্ষেপণ।

এভাবেই আসে ২৫ মার্চের কালরাত্রি। পাকবাহিনী ভারী অস্ত্র, কামান, সাঁজোয়া যান, ট্যাংক নিয়ে অপারেশন সার্চলাইট নামে এ দেশের ছাত্র, জনতাসহ নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেতে ওঠে নির্মম হত্যাযজ্ঞে। তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা, শাঁখারীবাজার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে নৃশংস হামলা চালায়। সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে গোটা জাতি। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। অসীম ত্যাগ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান বাঙালিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র দিয়েছে। প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙলি তার মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হয়।

পরিশেষে বলছি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ওই ভাষণ এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এটা কালজয়ী ভাষণ। ওই ভাষণের আবেদন খুব সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায় না। এটি একটি জাতির মুক্তির গাইডলাইন।

লেখক : সংসদ সদস্য ঢাকা-১৮, সদস্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close