প্রকাশ ঘোষ বিধান

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন

বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্য ভরা এ বনের রয়েছে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান বছরে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন সংকটাপন্ন। জলবায়ু পরিবর্তন ও সচেতনতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বনের মূল্যবান প্রাণী ও সম্পদ।

সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বিশ্বে বিরল প্রজাতির বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসভূমি এই সুন্দরবনে। বাংলাদেশের আয়তনের ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং বনাঞ্চলের ৪৪ শতাংশ জুড়ে থাকা এ বনের প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। মূল্যবান প্রাণিজ, জলজ ও বনজসম্পদ মিলে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। এই সুন্দরবন শুধু জীববৈচিত্র্যের উৎস নয়, একই সঙ্গে বনসংলগ্ন লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস হিসেবে অবদান রাখছে। দেশের অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল।

জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ায় সুন্দরবন এখন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক ভ্রমণকেন্দ্র। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার ২৮০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবনের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই গর্বের। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে সুন্দরবন গড়ে উঠেছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে। বৈজ্ঞানিক, নৃ-তাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিবেচনায় সুন্দরবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীববৈচিত্র্যের আধার ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ১৯৯৭ সালে তিনটি অভয়ারণ্য এলাকাকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেসকো। তিনটি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ওই বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকার আয়তন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর।

সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহৎ জলাভূমি। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার, যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। এ ছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। এই জলভাগে ছোট-বড় ৪৫০টি নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার। সুন্দরবনের আয়তনের ৬৮ দশমিক ৮৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪২ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে স্থলভাগ। সংরক্ষিত এই বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেসকো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণা করে, যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩০ ভাগ এলাকা। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এ ছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনাপানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা প্রতিকূল পরিবেশ, নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে শুধু বাঘ নয়, বনের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সাগরে পানির মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করে বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। ইতিধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্যমহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গণ্ডার, এক প্রজাতির মিঠাপানির কুমির। সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সরকার ২৯৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রতিবেশ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা, বিজ্ঞানভিত্তিক বন ব্যবস্থাপনা ও উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। তবে পুরো সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের ১৮টি রাজস্ব অফিস, ৫৬টি টহল ফাঁড়িতে জনবলের সংখ্যা ৮৮৯ জন। এই অপ্রতুল জনবল দিয়ে বিশাল এই সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিকে দেখভাল করা খুবই কঠিন কাজ।

সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদ-নদীতে জাহাজ ডুবে তেল, ফার্নেসওয়েল, ফ্লাই অ্যাশ, সিমেন্ট, কয়লা সারসহ রাসায়িক দ্রব্যে মারাত্মক পানিদূষণ হচ্ছে। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার নদীর পানিদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে প্রাণিকূল ও বনজসম্পদ। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান ক্ষতবিক্ষত হয়। আর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে অণুজীব থেকে শুরু করে বাঘ, হরিণ ও বনজীবীদের ওপর। বনের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যায়। সুন্দরবনের শ্বাসমূলসহ জীববৈচিত্র্য, মাছ ও জলজপ্রাণীর প্রজননের অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া সুন্দরবনের পাশেই মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে সুন্দরবনের আশপাশে ১৫৪টিরও বেশি বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিবেশবাদীদরা উদ্বিগ্ন।

বাংলাদেশের উপকূলের মানুষের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের রক্ষাকবজ হিসেবেও কাজ করে। বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্টি হওয়া যেকোনো ঝড়-ঝঞ্ঝায় সুন্দরবন নিজের বুক পেতে দিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এসব ঝুঁকির অন্যতম হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা। নদ-নদীতে সমুদ্রের পানি ঢুকে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়ে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষায় দিতে হবে অগ্রাধিকার। অবৈধভাবে প্রাণীশিকার বন্ধসহ সুন্দরবনের সুরক্ষায় যত্নবান হতে হবে। দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার্থে সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনিবার্য। নিজেদের প্রয়োজনে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close