ওসমান গনি

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

সরিষার বাম্পার ফলনে চাষিদের মুখে হাসি

আমাদের অর্থকরী ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। গেল বছর ভোজ্য তেলের দাম অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাসহ অনেক জায়গায় ব্যাপকহারে সরিষার চাষ হয়েছে। সরিষার ফলনও হয়েছে কৃষকের আশানুরূপ। এতে করে সরিষাচাষিরা ভীষণ খুশি। ফসলের মাঠে এখন খণ্ড খণ্ড হলুদ সরিষা ফুলের সমারোহ, মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ। ফসলের মাঠে সরিষার এমন দৃশ্য দেখা যায় দেশের অনেক জেলায়। সরিষার বাম্পার ফলনে লাভবান হচ্ছেন কৃষক, হাসি ফুটেছে তাদের মুখে।

ভোজ্য তেলের চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ অবস্থায়, দেশে ৫০ ভাগ তেল উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমাতে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। প্রথম বছরেই এবার সারা দেশে দ্বিগুণ পরিমাণ সরিষা চাষ হয়েছে। সরিষা চাষে বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে এবং আগামী তিন বছরের মধ্যেই বছরে ভোজ্য তেল আমদানিতে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

শুধু সরিষার আবাদ বৃদ্ধিই নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে মৌচাষ ও মধুর উৎপাদন। অন্যদিকে, আমন ও বোরোর মধ্যবর্তী সময়ে পতিত জমিতে সরিষার আবাদ হওয়ায় ধানের উৎপাদন কমছে না, একই সঙ্গে কৃষকরা অতিরিক্ত ফসল হিসেবে এই সরিষা পেয়ে লাভবান হচ্ছেন। সরিষাচাষিরা যাতে সরিষার ভালো দাম পান, এ বিষয়ে সহযোগিতা করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার।

প্রকৃতির ছন্দে সারা দেশের মাঠগুলো এখন সরিষায় সজীব হয়ে উঠেছে। সরিষার বাম্পার ফলন অবশ্যই তাদের আয় বাড়বে বলে আশাবাদী কৃষকরা। সরিষার অনেক ব্যবহার রয়েছে। এই শীতের মৌসুমে সরিষার শাকের ধোঁয়াটে গন্ধে মুখের স্বাদ বেড়ে যায় অনায়াসে। তা বিক্রি করে কৃষকরাও বাড়তি আয় পান। সরিষা চাষের সঙ্গে বিটরুট চাষ বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। সরিষা ফুলের মধু সবার প্রিয়। আর এই মিষ্টি গুণ শেষ করা যাবে না। অনেক জায়গায় সরিষাখেত সাজানো আছে মৌমাছির বাক্সে, বাড়ছে মৌমাছির আনাগোনা! মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছে। আর রানি মৌমাছি পাহারা দিচ্ছে। কি অপরূপ দৃশ্য!

এই সরিষা ফুলের মধু বাজারে খুবই জনপ্রিয়। দামও বেশ চড়া। ফলে সরিষা চাষের পাশাপাশি মৌমাছি পালনকারী কৃষকরা সহজেই বাড়তি আয় পাবেন। বাজারে ভোজ্য তেলের দাম অনেক বেশি। সয়াবিন তেল সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। আর তাই ভোজ্য তেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে তৈলবীজ ফসলের আবাদ বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাগিদ রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সরিষা চাষ বাড়াতে তৎপর হয়েছে। কৃষকরাও সরিষা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে চলতি মৌসুমে সারা দেশে সরিষার আবাদ চোখে পড়ার মতো! হলুদ সরিষা ফুলের আকর্ষণে পর্যটকরাও আকৃষ্ট!

একসময় সয়াবিন তেলের চেয়ে সরিষার তেল বেশি ব্যবহৃত ও মূল্যবান ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এদিন আবারও ফিরে আসবে আমাদের মধ্যে। ঘানিতে খাঁটি সরিষার তেল সংগ্রহের জন্য মানুষ এখনো দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছে। এ দৃশ্য প্রতিনিয়ত দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে। এই তেলের দাম বেশ চড়া। এখন রান্নায় সহজে সরিষার তেল ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা। এটি স্বাস্থ্যকরও বটে। রান্নায় সরিষার তেলের ব্যবহার ছাড়াও এর রয়েছে নানা ব্যবহার। আচার তৈরিতে সরিষার তেলের মিশ্রণ! সরিষার তেলের ভিটামিন ‘ই’ শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সরিষার তেলের অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট বৈশিষ্ট্য শ্লেষ্মা এবং অবরুদ্ধ সাইনাস পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। বিভিন্ন ভোজ্য তেলের সঙ্গে তুলনা করে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সরিষার তেল কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি ৭০ শতাংশ হ্রাস করে।

এর ব্যবহার কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। চুল ও ত্বকের যত্নেও সরিষার তেল উপকারী। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সরিষার তেল খাঁটি কি না তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। বিভিন্ন জাতের সরিষার বীজে প্রায় ৪০-৪৪ শতাংশ তেল থাকে। খৈল প্রায় ৪০ শতাংশ আমিষভোজী। তাই খৈল গরু-মহিষের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। দেশের গ্রামীণ জীবনে এই সরিষার তেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রান্নার পাশাপাশি সর্দিজ্বর বা ভেষজ ওষুধ তৈরিতেও এই তেলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরিষার উপজাত জ্বালানি ও খৈল গ্রামীণ মহিলাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। মাছ বা গবাদি পশুর খাদ্য এবং মাটির জৈব সার হিসেবে এর প্রচুর অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশে সরিষার চাষ বাড়ছে। ইয়ার বুক এগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিস্টিক-২০২১-এর সূত্র অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে দেশে রাই/স্থানীয় ও এইচওয়াইভি জাতের ৮ লাখ ১৪ হাজার ২৮৮ দশমিক ৫৪ একর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। যার উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৯৪ দশমিক ২৮ টন।

সরিষার অনেক জাত রয়েছে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি সরিষার জাত অনুসরণ করে ধান চাষ করা যায়। স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের পর স্বল্পমেয়াদি সরিষা চাষ বোরো ধান অনুসরণ করা যেতে পারে। ফলে, একটি নতুন লাভজনক শস্যবিন্যাস যেমন আমন-সরিষা-বোরো উদীয়মান হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে।

এটি দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করবে এবং কৃষকদের আয় বাড়াবে। স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমন ব্রি ধান ৭১, ব্রি ধান ৭৫ এবং স্বল্পমেয়াদি বোরো ধান যেমন ব্রি ধান ৬৭ (বিআরআই), যা লবণাক্ত সহনশীল। তবে দেশের অনেক কৃষক একক ফসল হিসেবে সরিষা চাষ করে লাভবান হয়েছেন বলে জানা গেছে। কৃষকপর্যায়ে এই উচ্চ ফলনশীল সরিষা জাতের বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা জরুরি।

সরিষা সংগ্রহের পর আধুনিক প্রযুক্তিতে সরিষার খৈল আহরণ বা সম্প্রদায়ভিত্তিক ঘানির ব্যবস্থা করলে কৃষকরা সহজেই তেল উত্তলন করতে পারে। সূত্র জানায়, সাধারণত দুভাবে সরিষার তেল উত্তোলন করা হয়। প্রথমটি হলো, ঘানি ভাঙা। এটি কাঠের এবং ধাতু উভয় সংস্করণে পাওয়া যায়। সাধারণ তাপমাত্রায় সরিষার তেল বের করা হয়; নিষ্কাশিত তেলের পুষ্টির মান অক্ষত থাকে। এই পদ্ধতিটি উৎপাদিত তেলের পরিমাণ এবং তেলের স্থিতিশীলতা হ্রাস করে। যে কারণে এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলের (বোতলজাত) দাম বেশি। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলকে ভার্জিন গ্রেড বলে।

দ্বিতীয়টি হট প্রেসিং। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে তেল তৈরি করা হয়। কারণ যেসব তৈলবীজের তেলের পরিমাণ কম থাকে (যেমন সয়াবিন তেলের পরিমাণ ১৭-২০ শতাংশ) গরম চাপ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। পরিমাণ কমে যায় এবং ফ্রি রেডিকেল, ট্রান্সফ্যাট ইত্যাদির পরিমাণ বাড়ে। যার কারণে এভাবে উৎপাদিত তেল দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে শরীরে রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে, এমন অপপ্রচার রয়েছে দৈনিক পত্রিকার খবরে।

পুষ্টির দিক থেকে কোল্ড প্রেসড অয়েলের বিকল্প নেই। কিন্তু সব তেলবীজকে ঘানিতে রূপান্তর করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে যেসব বীজে তেলের পরিমাণ কম। বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে শুধু সরিষাকে ঘানিতে ভেঙে ফেলা হয়। দেশীয় পদ্ধতিতে এই তেল উত্তোলন করা সম্ভব হওয়ায় এ তেল ভোজ্য তেলের মতো নিরাপদ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের ভোজ্য তেলের ঘাটতি পূরণের জন্য দেশের প্রতিটি এলাকার আমন ধান কাটার পরপর প্রচুর পরিমাণে সরিষা চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। অধিক পরিমাণ সরিষা আমরা নিজেরা উৎপাদন করতে পারলে বিদেশ থেকে আমাদের আর ভোজ্য তেল আমদানি করতে হবে না। সাশ্রয় হবে আমাদের অর্থ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে সব সময় ভোজ্য তেল আমদানি করে চাহিদা মেটানো সম্ভব না। তাই নিজেদের স্বার্থে সরিষা চাষে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশের যেসব জমি প্রতি বছর পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে সেগুলোকে পরিচর্যা করে চাষের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা যদি ভোজ্য তেলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হই, তাহলে অর্থনৈতিকভাবেও আমরা অতি দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close