মো. সাখাওয়াত হোসেন

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

অঙ্গীকার হোক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু শিখিয়েছে আবার মনোজগতের চিন্তার জায়গাতেও নাড়া দিয়েছে। আমরা দেখেছি দেশে একটি গোষ্ঠী নির্বাচন প্রতিহত করতে ষড়যন্ত্র করেছে, ষড়যন্ত্র করেই ক্ষান্ত হয়নি উল্টো নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে হরতাল অবরোধের মতো জনবিরোধী কর্মসূচি প্রদান করেছে। আবার বিদেশি একটি গোষ্ঠী রয়েছে যারা বাংলাদেশকে সহ্য করতে পারে না, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করে, বাংলাদেশে তাদের ইচ্ছেমতো সরকার পরিচালিত না হওয়ায় এ গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে এ শক্তিটি কাজ করেছে। এর বিপরীতে সংবিধানের আলোকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭ জানুয়ারি ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনে এ দেশের জনগণ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের রায় প্রদান করেছে। পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট প্রদান করে নির্বাচন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মর্যাদা প্রদান করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিদেশিদের ষড়যন্ত্রে চপেটাঘাত করতেও দ্বিধা করেনি এ দেশের আপামর জনতা। বাংলাদেশের মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর অধিকার দেওয়া হয়নি।

আমরা প্রত্যেকেই জানি, উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাষ্ট্র বাংলাদেশের অগ্রগতিকে মনিটরিং করেছে, মূল্যায়ন করছে বিশ্লেষণের মাধ্যমে। বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি এখন বাংলাদেশ। অগ্রগতির ধারা বিদ্যমান থাকলে ২০৩৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম হবে। পাশাপাশি ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ে সরকার রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। ২০০৯ সাল থেকে বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ব্যাপক সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশ উন্নতি লাভ করেছে। দারিদ্র্যবিমোচনে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে। ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬০ ডলারে। কাজেই অগ্রগতির সূচকে যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ অসম্ভব কিছু নয়। তার লক্ষ্যে সব বাংলাদেশিদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।

করোনা মহামারির পূর্বে আমাদের জিডিপি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশে। করোনা মহামারিকালে যেখানে অন্য দেশগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছিল, সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এখন প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে। শিল্প খাতে জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে ২২ থেকে ৩৭ শতাংশ হয়েছে। ২০০৬ সালে গড় আয়ু ছিল ৫৯ বছর। এখন আমাদের গড় আয়ু ৭৩ বছর। একই সঙ্গে দ্রুত কমেছে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার। দক্ষিণ এশিয়ায় লৈঙ্গিক সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন শীর্ষস্থানে। বাংলাদেশের জিডিপির আকার এখন ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০০৬ সালে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬০ বিলিয়ন ডলার। বেকারত্বের হার নেমে এসেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বিনা মূল্যে জমি ও ঘর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দেশের প্রথম সর্বজনীন পেনশন চালু করেছে। সরকারের যথাযথ ও যুগোপযোগী পদক্ষেপের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যেমন সম্ভব হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে গৃহীত ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক ফলাফলও পরিলক্ষিত হয়েছে।

খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীনদের জমি ও ঘর প্রদান, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, ক্ষুদ্রশিল্পের উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, উদ্যোক্তা বৃদ্ধি এবং নতুন ধারণার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বড় অর্জন করেছে বাংলাদেশ। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তথা অনগ্রসর জাতি গোষ্ঠীর জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার, স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনকল্যাণ নিশ্চিতে সরকারের গৃহীত ?উদ্যোগ কার্যকর হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

মোট কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ আর তথাকথিত সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে বাংলাদেশকে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে হয়েছে। এই অগ্রযাত্রায় ষড়যন্ত্রকারীরা অব্যাহতভাবে দেশকে পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে এ কথা অনুমেয় যে, ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে কোনোভাবেই লাভবান হওয়া যায় না। হয়তো কিছুটা সময়ের জন্য লাভবান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। কাজেই যে বা যারাই আপনারা হোন না কেন, বিদেশিদের সঙ্গে উতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি নিবেদন থাকবে আপনারা ভুল রাস্তা থেকে ফিরে আসুন। ইতিহাস কখনো ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। এ দেশ আমার, আপনার, আমাদের। দেশের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করার মানসে ইতিবাচকভাবে রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াতে হবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি যেমনভাবে বৃদ্ধি করবে, ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্রের সুসংহত অবস্থান নাগরিকদের স্থিতি ও সচ্ছলতা প্রদান করবে। আমরা মনেপ্রাণে বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করি বাংলাদেশ যেভাবে ইতিবাচক উপায়ে বিভিন্ন সেক্টরে স্বাক্ষর রেখে চলছে, এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখাটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের এবং আমরা যদি ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারি, তাহলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে রূপরেখা আমরা প্রণয়ন করেছি, তার বাস্তবায়ন কোনোভাবে অসম্ভব নয়। মনে বিশ্বাস রাখতে হবে, প্রতিকূলতাকে মাড়িয়ে সামনে পথচলার সাহস সঞ্চার করতে হবে, ষড়যন্ত্রকারীদের পদদলিত করতে হবে, ষড়যন্ত্রে মদদদাতাদের চরিত্রকে উন্মোচনের মাধ্যমে সুখী, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমরা সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখাটা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।

কেননা বাংলাদেশের যে জনশক্তি রয়েছে, যে সম্ভাবতা রয়েছে, যে সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে, যে কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিপুল পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে; সবকিছুর সঠিক বাস্তবায়নই মূলত বাংলাদেশকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তৈরি করবে। বর্তমানে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে, সেটিকে ধরে রাখতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র গঠনের মূলমন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্র, গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করতে একটি শ্রেণি সব সময়ই কাজ করে থাকে। তাদেরও সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে। কেননা সামরিক সরকার তথা স্বৈরশাসনের শাসনকাল বাংলাদেশ অবলোকন করেছে, মানুষের স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার নামান্তর হচ্ছে গণতন্ত্রকে হত্যা করা। যেকোনো উপায়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সরকারব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, লাখো শহীদের পবিত্র আত্মাকে কোনোভাবেই অপমান করা যাবে না।

পরিশেষে বলা যায়, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে কর্মউপযোগী জনগণের কর্ম নিশ্চিত করার সব ব্যবস্থা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের দাবিকে গুরুত্ব প্রদান করে কর্মসূচি প্রদান করতে হবে। দেখা যায়, কিছু রাজনৈতিক দল হাতিয়ার হিসেবে হরতাল-অবরোধের কৌশলকে গ্রহণ করে থাকে। এ ধরনের জনবিরোধী কর্মসূচি থেকে দূরে সরে আসতে হবে। পরিবর্তিত যুগে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি দেওয়া জরুরি। কৃত্রিমভাবে যারা সংকট সৃষ্টি করে জনসাধারণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। দুর্নীতিকে যেভাবেই হোক জাদুঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের যে অমিত সম্ভাবনার ক্ষেত্র রয়েছে সম্ভাবনাগুলোকে পরিষ্কারভাবে কাজে লাগাতে পারার মতো জনশক্তি আমাদের তৈরি করতে হবে এবং এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পরিচিতি পাবে পৃথিবীব্যাপী।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি

ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close