মো. সাখাওয়াত হোসেন

  ২০ জানুয়ারি, ২০২৪

মতামত

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের পরিবেশকে সবার জন্য এক ও অভিন্ন রাখার স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা লক্ষ করেছে এ দেশের আপামর জনসাধারণ। শুধু তা-ই নয়, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেছে কমিশন এবং যেসব দল সংলাপে অংশ নিয়েছে, তাদের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনে ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। শুধু তা-ই নয়, তফসিল ঘোষণার পরবর্তী সময়ে প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাছাই নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি।

নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিনেও নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতাবলে প্রার্থিতা বাতিল করেছে প্রার্থীদের। অর্থাৎ নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছে, যা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। কিছু সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনের কাজে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে, এমন নমুনা প্রতীয়মান। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে, এমন অভিযোগ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো প্রার্থী কিংবা দল লিখিত আকারে উপস্থাপন করেনি। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পদায়ন কমিশনের ইচ্ছায় হয়েছে। কাজেই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য ১২ লাখ জনবলের প্রয়োজন রয়েছে। সে জায়গায় কমিশনের জনবল রয়েছে ১৫০০ জনের কাছাকাছি। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্যান্য বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। বিশেষ করে একটি গোষ্ঠীর নির্বাচন প্রতিহত করার হুমকি সত্ত্বেও ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারে, সেই লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে কোনো ধরনের গোলযোগ দেখা দেয়নি। কিংবা প্রতিহত করতে উদ্ধত হওয়া গ্রুপটি নির্বাচনের দিন সহিংস আচরণ করার ফুসরত পায়নি। বিভিন্ন কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে পুলিশের কাঁধে করে বয়স্করা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করছে; এমন দৃশ্য বাংলাদেশ পুলিশের ফেসবুক পেজে দেখা গেছে। কাজেই নির্বাচনের দিন শুধু নয়, তফসিল ঘোষণার পরবর্তী সময় থেকেই কমিশনের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভোটগ্রহণের প্রাক্কালে প্রিসাইডিং অফিসারদের পক্ষপাতমূলক আচরণের খবরাখবর মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় জানা যায়। কিন্তু এবারকার নির্বাচনে দু-এক জায়গা ছাড়া প্রিসাইডিং অফিসারদের ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন নিয়ে নেতিবাচক অভিযোগ উঠে আসেনি। যেখানে সমস্যা দেখা গেছে কমিশন তৎক্ষণাৎ ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। ভোট সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ আয়োজনে প্রিসাইডিং অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। প্রিসাইডিং অফিসারদের পক্ষমাতমূলক আচরণ ভোটের হিসাবনিকাশ নিমিষেই পাল্টে দিতে পারে। সে জায়গায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং অফিসারদের দায়িত্বশীল আচরণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশ-বিদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মর্যাদা দিয়েছে। নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে সরকার গঠিত হয়েছে এবং নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছে। মূলত এসব শুভেচ্ছা বার্তা ও রাষ্ট্রদূতদের সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বাসনাই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করে। কাজেই যে বা যারা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের কাছে এসব দৃষ্টান্ত চপেটাঘাত হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

মিডিয়াকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশের সব কটি ভোটকেন্দ্রে দেশি-বিদেশি মিডিয়াকর্মীরা সংবাদ পরিবেশন করেছে। কোথাও কোনোরূপ গোলযোগের সংবাদ চোখে পড়েনি। যেখানে গোলযোগের চেষ্টা করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে কমিশন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং ভোটকেন্দ্র বাতিল করার ঘটনাও ঘটেছে। মিডিয়াকর্মীদের দৃষ্টিতে নির্বাচনে ভোট কারচুপি হয়েছে কিংবা হয়রানি হয়েছে মর্মে সংবাদ পরিবেশিত হয়নি। কাজেই বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার ক্ষেত্রে যারা অগ্রসরমান, তাদের কাছে নির্বাচনকে পক্ষপাতদুষ্ট দেখানোর তেমন কোনো আলামত নেই। একটা সময় দেখা গেছে, ভোটে কেউ পরাজিত হলে ভোটে কারচুপি হয়েছে মর্মে অভিযোগ প্রদান করত। কিন্তু ভোটের মাঠে না থেকেও ভোট কারচুপির অভিযোগ কোনোভাবেই জুতসই নয়। অবশ্য তাদের অভিযোগ শুধু নামেই থেকে যাচ্ছে, বাস্তবে সেসবের কোনো প্রতিফলন নেই।

ভোটগ্রহণের আগে বিদেশি সাংবাদিক, সংগঠন ও সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনে এসেছে এবং নির্বাচন নিয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। কমিশন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নির্বাচনের দিন ভোটের পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করার অনুরোধ জানিয়েছে। তৎপ্রেক্ষিতে ভোটের মাঠে বিদেশিদের দেখা গেছে এবং ভোটগ্রহণ শেষে বিদেশিরা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ নিয়ে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ভোটগ্রহণের পরবর্তী সময়ে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। তবে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে কিছু বিদেশি যে সমালোচনা করেনি, সেটিও বলা যাবে না। তবে যারা সমালোচনা করেছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ষড়যন্ত্রমূলক ও উগ্র স্বভাবের। তারা অবৈধভাবে আমাদের দেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছিল। তফসিল ঘোষণার পর তারা বলেছিল, ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। আবার ভোট যখন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো, তখন তারা যুক্তি দেখাল সব দল নির্বাচনে আসেনি, তাই নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ। আচ্ছা আপনারাই বলুন তো, নির্বাচন কমিশন কি নিয়মের বাইরে গিয়ে নির্বাচন আয়োজন করেছে? নির্বাচনে কি সব দলের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না? তাহলে যারা নির্বাচনে আসেনি তাদের ব্যাপারে কেন আপনাদের অভিমত? আপনারা তাদের বিষয়ে বলতে পারেন যারা নির্বাচনে এসেছে, ভোটের মাঠে ছিল তাদের অভিমত এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কতিপয় বিদেশি এসব বিষয়কে বাইরে রেখে শুধু নিজেদের স্বার্থের জন্য নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা করছে।

প্রকৃত অর্থে নির্বাচন কেমন হয়েছে, তার প্রকৃত মূল্যায়নকারী হচ্ছে এ দেশের জনগণ। নির্বাচনে এ দেশের ৪১ শতাংশ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রদান করেছে। ভোট প্রদানের সময় কোনোরূপ বাধার সৃষ্টি হয়নি ভোটারদের। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে নির্বিঘ্নে, এটাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। ভোটকেন্দ্রে কোনো গোলযোগ সৃষ্টি হয়নি, প্রিসাইডিং অফিসাররা নিরপেক্ষভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। নির্বাচন কমিশন শতভাগ নিরপেক্ষ থেকে সাহসিকতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ জনগণের কোনো প্রশ্ন নেই, সাধারণ জনগণের আগ্রহ এখন গঠিত মন্ত্রিসভা নিয়ে। মন্ত্রীদের কাছে জনতার প্রত্যাশার কথা গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে এবং দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করছেন গণমাধ্যমে। সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য সর্বমহলে। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তারা জনগণের ম্যান্ডেট হারিয়েছে। নির্বাচন সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে পাঁচ বছর পর। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু আয়োজনে যারা ভূমিকা রেখেছে, প্রত্যেকেই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য এবং এ দেশের আপামর জনসাধারণ নির্বাচনকে বৈধতা প্রদান করেছে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close