মো. নেছার উদ্দিন চৌধুরী

  ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

ক্ষণস্থায়ী আনন্দ চিরস্থায়ী ক্ষতি করছে না তো?

‘স্বাধীনতা’ নামে একটা শব্দ আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। কিন্তু এই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা আমরা কি আদৌ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করছি? নাকি আমরা সেটা ব্যবহারে অক্ষম? নাকি আমরা এর মর্মার্থ বুঝতে পারছি না? স্বাধীনতা মানেই কি নিজের মনমতো চলা? অন্যের মতকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা? নাকি অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা? আসলে তো ব্যাপারটা এমন না। ব্যাপারটা হচ্ছে- আমি আমার মতো বা কথা বা আচরণ ততটুকুই করব যতটুকু করলে অন্যের কোনো ক্ষতি হবে না- এটাই হচ্ছে স্বাধীনতা। আমরা আসলে স্বাধীনতার মানেই বুঝতে পারি না। যার জন্য বছরের প্রথম দিন ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন নামে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ করি নিজেকে স্বাধীন ভেবে। সেই স্বাধীন আনন্দটা আসলেই কারো কোনো ক্ষতি করছে কি না- সে বিষয়ে আমাদের ভ্রুক্ষেপ আছে কি?

বছরের প্রথম দিন আতশবাজি ও ফানুস উড়িয়ে আমরা যে আনন্দ করি সে আনন্দ আমাদের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি পরিবেশ, পশুপাখির জন্যও হুমকিস্বরূপ। আসলে এই উদযাপনের ধারাটা কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা যায়। চীনা উপকথায় ‘নিয়ান’ নামক শিংবিশিষ্ট এক দৈত্যের কথা জানা যায়। চায়নিজ নববর্ষের আগের রাতে এই দৈত্য গ্রামগুলোতে হামলা করত। তাই সে রাতের আগেই গ্রামবাসী পালিয়ে যেত। একবার, গ্রামবাসী পালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তখন এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক একটি গ্রামে প্রবেশ করল রাত্রিযাপন করার জন্য। তিনি নির্ভয়ে রাত কাটাল। পরদিন গ্রামবাসী তাকে গ্রামে দেখে অত্যন্ত আশ্চর্যন্বিত হলো। সেই সঙ্গে এটিও লক্ষ করল, তাদের প্রত্যেকের ঘরগুলো লাল রঙে রাঙানো এবং উঠান ও বাড়িগুলোতে কিছু বাজি পড়ে আছে। সেই থেকে গ্রামবাসীর ধারণা, ‘নিয়ান’ আলো, শব্দ এবং লাল রঙকে ভয় পায়। এখান থেকেই অপশক্তিকে তাড়ানোর জন্য আতশবাজি ব্যবহার শুরু করেছেন চীনারা। খ্রিস্টপূর্ব ২ শতকে ফাঁপা বাঁশের ডাটা আগুনে নিক্ষেপ করে সেগুলোকে বিস্ফোরিত করত আর এভাবেই আলোর প্রজ্বালনের মাধ্যমে নববর্ষ উদযাপন করত। যদিও এটা তাদের একটি প্রচলিত ধারণা ছিল তাই তারা উদযাপন করত। কিন্তু বর্তমানে এর ক্ষতি বুঝতে পেরে তারা অনেকটাই এটা থেকে নিজেদের সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

কিন্তু আমাদের মতো তথাকথিত স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি জাতি কখনো এর ক্ষতিকর দিকটা উপলব্ধি করতে পারছে না। চীনের ৩৩৫টি শহরে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে, বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় নববর্ষে আতশবাজি ব্যবহারে বাতাসে ক্ষতিকর কণার পরিমাণ ৮৯ শতাংশ বেড়ে যায়। এ ছাড়া বায়ুমান সূচক ও সালফার-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে যথাক্রমে ৫৭ ও ৬৯ শতাংশ। আমাদের দেশের স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) রাজধানীর মোট ১১টি স্থানে ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরর রাত ১১টা থেকে ১২টা ও ১২টা থেকে ১টার শব্দের মাত্রার তথ্য সংগ্রহ করে এবং এ সময় বায়ুদূষণের পরিমাণটাও সংগ্রহ করে। এতে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ে শব্দের যে মাত্রা থাকে থার্টিফার্স্ট নাইটে সেটা ৪০ গুণ বেড়ে যায়। স্বাভাবিক সময়ে যেটা হওয়ার কথা ৫৫ থেকে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে আর ওই দুই ঘণ্টায় গড়ে সেটা হয় ৯০ থেকে ১১০ ডেসিবেলের মধ্যে। অন্যদিকে ৩০ শতাংশ বেশি বায়ুদূষণ হয়। স্বাভাবিক সময়ে বায়ুতে প্রতি ঘন মিটারে ১৫০ থেকে ১৬০ মাইক্রোগ্রাম ধুলাবালি থাকে। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর রাতে সেটা বেড়ে প্রতি ঘনমিটারে ২২০ থেকে ২২৫ মাইক্রোগ্রাম হয়ে যায়। এটা তো গেল শব্দদূষণের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর দিক। শুধু এই ক্ষতি লক্ষ করে চীন এখন আতশবাজি আমদানি না করে বরং রপ্তানিতে শীর্ষ হচ্ছে।

ওয়ার্ল্ডস টপ এক্সপোর্টস ও ট্রেন্ড ইকোনমির তথ্য মতে, ২০২২ সালে ১,১০০ মিলিয়ন ডলারের আতশবাজি রপ্তানি করে রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে ছিল চীন। ৩১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে দ্বিতীয় স্থানে জার্মানি। ৩০ দশমিক ৫ ডলার রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস তৃতীয়। অন্যদিকে আমদানির ক্ষেত্রে ৮০৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে শীর্ষস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। পোল্যান্ড ও ইতালি ৫৫ ও ৫৪ মিলিয়ন ডলার খরচ করে দ্বিতীয় তৃতীয় স্থানে অবস্থান করেছিল। আমাদের বাংলাদেশে আতশবাজি বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও ঢাকার শাঁখারীবাজার ও চকবাজারের ১৩০ থেকে ১৫০টি দোকান সারা দেশে চাহিদার ৮০ শতাংশ আতশবাজি সরবরাহ করে। এই ব্যবসায়ীরা নববর্ষ উপলক্ষে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি করে।

যদিও চীনেই আতশবাজির প্রচলন শুরু হয় কিন্তু চীন এখন নিজেদের এটা থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে আর আমরা সেটাকে অনুসরণ করছি। মানুষ এবং পশুপাখির জন্য এই আতশবাজির ক্ষতি অকল্পনীয়। অতিরিক্ত শব্দের কারণে হার্ট অ্যাটাকে মানুষের যেমন মৃত্যু হয়, পাশাপাশি পশুপাখিরও মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার এক শিশু অতিরিক্ত আতশবাজির শব্দের কারণে মারা যায়। যার বাবার আর্তনাদ এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ২০২১ সালেও মাহমুদুল হাসান নামের এক শিশুর মৃত্যু হয় একই কারণে। ২০২১ সালে আতশবাজি ফোটানোর কারণে ইতালির রোম শহরে কয়েক হাজার পাখি মারা যায়। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আর্কানসাস অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার লাল ডানার পাখি মারা যায়। কুকুরের শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে চার গুণ বেশি। কুকুর ৬০ হাজার হার্জ পর্যন্ত শব্দ শুনতে পায়। ৩১ ডিসেম্বর রাতে কুকুরগুলো পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে অতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে। আতশবাজির জন্য ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্যানসারেরও সম্ভাবনা থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, থার্টিফার্স্ট নাইটে যেসব আতশবাজি ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সালফার, পটাশিয়াম নাইট্রেট, লেড ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর পিএম ১০ ও ২ দশমিক ৫ কণা থাকে, যা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। এতে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। মানুষের চুলের গড় আকার ৭০ মাইক্রোমিটার হলে পিএমণ্ড১০-এর সাত ভাগের এক ভাগ। আর পিএম ২ দশমিক ৫ হলো তার?ও চার ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ, এতটাই ক্ষুদ্র যে, এই কণাটি সহজেই রক্তে প্রবেশ করতে পারে। ফলে, ভারী ধাতু-সংবলিত এসব কণা রক্তে প্রবেশ করলে জীবন অনেকটাই ঝুঁকিতে বলা চলে।

এবার দেখা যাক ফানুসের ক্ষতিকর দিকটা, ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক লাইনে ফানুস পড়ার কারণে ২ ঘণ্টা বন্ধ ছিল মেট্রোরেল। ২০২২ সালে ফানুসের কারণে প্রায় ১০০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আনুমানিক ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। ২০২১ সালে সারা দেশে অন্তত ২০০টি স্পটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১৬টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। তা ছাড়া ২০২০ সালের ৫০টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। একদিকে যেমন আমাদের পরিবেশের জন্য চিরস্থায়ী ক্ষতি, অন্যদিকে আমাদের পশুপাখি এবং আমাদের নিজেদের জীবনের জন্য এ ধরনের উদযাপন চিরস্থায়ী হুমকিস্বরূপ। তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে, যেন মাহমুদুল হাসানের মতো ছেলেদের মা-বাবাকে আর কান্না করতে না হয়। যেন হাজার হাজার পাখি তাদের সুখের নিবাস না হারাতে হয়। যেন কোটি কোটি মানুষ ক্যানসার ও হৃদরোগের মতো কঠিন ব্যাপারগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close