এম এ মান্নান

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

সয়াবিন চাষ বৃদ্ধির বিকল্প নেই

বিশ্বব্যাপী তেলজাতীয় ফসলের ৫০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে সয়াবিন। ট্রেডিং ইকোনমিকস অনুসারে, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং প্যারাগুয়ে সয়াবিনের প্রধান উৎপাদক। রপ্তানিকারক হচ্ছে চীন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মেক্সিকো এবং জাপান প্রধান আমদানিকারক। কয়েক বছর আগে উপেক্ষিত থাকলেও ক্রমান্বয়ে অর্থকরী ফসল হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বাংলাদেশেও বাড়ছে; বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং ভোলা জেলায় এর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬২ হাজার ৮৭০ হেক্টর আবাদি জমি থেকে বছরে ৯৬ হাজার ৯২১ টন সয়াবিন উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৭০ ভাগ লক্ষ্মীপুর জেলায় উৎপাদিত হচ্ছে, যদিও দেশে ডেইরি ও পোলট্রি সেক্টরে চাহিদা মেটাতে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন সয়াবিন প্রয়োজন।

সয়াবিন চাষ করা খুব সহজ। দোআঁশ, বেলে দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ মাটি সয়াবিন চাষের জন্য উপযুক্ত। ৪-৫টি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হয়। রবি মৌসুমে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এবং খরিপ মৌসুমে জুলাই-আগস্ট মাসে বীজ বপন করতে হয়। সারি থেকে সারি ১ ফুট এবং বীজ থেকে বীজ ৫-১০ সেন্টিমিটার দূরে বপন করলে ফলন বেশি হয়। তবে ছিটিয়েও বীজ বপন করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সয়াবিনের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে এবং কৃষকপর্যায়ে চাষ হচ্ছে। প্রতি হেক্টরে গোবর ২০ টন, ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি ১৫০ কেজি ও এমওপি ১০০ কেজি দিয়ে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে জীবাণু সার প্রয়োগ করলে ইউরিয়া সার লাগে না। আগাছা হলে দমন করতে হবে। খরা হলে সেচ দিতে হবে। পোকামাকড়ের মধ্যে বিছাপোকায় সয়াবিন গাছ আক্রান্ত হলে আক্রমণের প্রথম অবস্থায় পোকাসহ পাতাটি তুলে পায়ে মাড়িয়ে বা গর্তে চাপা দিয়ে মারতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক এবং সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক যেমন কট ১০ ইসি ১ মিলিলিটার বা সিমবুশ ১০ ইসি ০.৫ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। ছাই ছিটিয়ে বা নগস স্প্রে করেও দমন করা যায়। কাণ্ডের মাছি ও পাতা মোড়ানো পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় না। ৯০ থেকে ১২০ দিনে সয়াবিন পরিপক্ব হয়। প্রতি হেক্টরে ১৫০০ থেকে ২০০০ কেজি ফলন হয়। সয়াবিনের বীজ সংরক্ষণে বীজের আর্দ্রতা ১০-১২ শতাংশ হতে হবে। পাত্রের মুখ ভালো করে বন্ধ রাখতে হবে। বীজের পাত্র রাখতে হবে ঠাণ্ডা স্থানে।

বাংলাদেশে সয়াবিন চাষে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও এ নিয়ে গবেষণা বেশি হয়নি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৯০ সালে সোহাগ (পিবি-২), ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সয়াবিন-৪ (জি-২), ২০০৬ সালে বারি সয়াবিন-৫, ২০০৯ সালে বারি সয়াবিন-৬ এবং ২০২০ সালে বারি সয়াবিন-৭ নামে সয়াবিনের জাত উদ্ভাবন করে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত সয়াবিনের ৭টি (বিনা সয়াবিন-১, বিনা সয়াবিন-২, বিনা সয়াবিন-৩, বিনা সয়াবিন-৪, বিনা সয়াবিন-৫, বিনা সয়াবিন-৬, বিনা সয়াবিন-৭) জাত উদ্ভাবন করেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগ ২০০৭ সালে তাইওয়ানের এশিয়ান ভেজিটেবল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দুই শতাধিক সয়াবিনের জেনিটিক লাইন সংগ্রহ করে সয়াবিন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। বর্তমানে এ বিভাগ সয়াবিন নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত এ বিভাগ বিইউ সয়াবিন-১, বিইউ সয়াবিন-২, বিইউ সয়াবিন-৩, বিইউ সয়াবিন-৪ নামে ৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে; যার মধ্যে বিইউ সয়াবিন-১ মাত্র ৬৫ থেকে ৭০ দিনে ফসল কাটা যায় এবং বিইউ সয়াবিন-৩ লবণ সহনশীল, যা উপকূলীয় জমিতে চাষের উপযোগী। এ বিভাগ খরা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল সয়াবিনের জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ২৮ দশমিক ৬০ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১০ দশমিক ৫৬ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। এ জমিতে লবণ সহনশীল সয়াবিন এবং বাংলাদেশের চরাঞ্চলে উচ্চফলনশীল সয়াবিনের চাষ করলে আমাদের দেশের পোলট্রি ও মাছের খাবারের চাহিদার অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় সয়া খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করতে পারি।

লেখক : অধ্যাপক ও সয়াবিন গবেষক, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close