মো. জিল্লুর রহমান

  ২৮ মে, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

নিরাপদ পৃথিবী রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব

আমরা যে বিশ্বে বাস করি, সেখানে প্রতিটি প্রাণী পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, এই বাস্তুতন্ত্রে প্রতিটি প্রজাতির আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে। প্রতিটি জীবই কোনো না-কোনোভাবে পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই জীবজগতের ভারসাম্য বজায় রাখা ও পরিবেশের সুরক্ষার স্বার্থে সব জীবকেই বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। মানুষ শুধু অন্যান্য প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ হচ্ছে না; তাদের কর্মকাণ্ড যদি এ ধারাতেই চলতে থাকে, তাহলে আমরা প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির বিলুপ্তির দিকেই এগিয়ে যাব।

খুব সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে এই পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রাণীর বাস, একেই জীববৈচিত্র্য বলে। আর বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে জীববৈচিত্র্য হলো উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ পৃথিবীর গোটা জীবসম্ভার, তাদের অন্তর্গত জিন ও সেগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্র। অতি শুষ্ক মরুভূমি থেকে অরণ্য পর্যন্ত, বরফে আবৃত কঠিন পর্বত থেকে সাগরের গভীরে বিস্তৃত হয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির জীবজগতের রং, আকৃতি, আকার ইত্যাদির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করে জীবন ধারণ করে আসছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে, জৈববৈচিত্র্য হলো জল, স্থল সবল জায়গায় সব পরিবেশে থাকা সব ধরনের জীব এবং উদ্ভিদের বিচিত্রতা। পৃথিবীর ১২ বিলিয়ন প্রাণীর একভাগ অংশতেই ৪৯ মিলিয়ন প্রজাতির বিভিন্ন জীব-জন্তু এবং উদ্ভিদের বসবাস।

উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ পৃথিবীর গোটা জীবসম্ভার মূলত তাদের অন্তর্গত জিন ও সেগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্র। তিনটি বিভিন্ন পর্যায়ে এগুলো বিবেচ্য, বংশানুসৃত বৈচিত্র্য, প্রজাতিগত বৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঠেকাতে সহায়তা জোগায়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক চুক্তিতে দেড় শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশও এ চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী। বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যে মোট প্রজাতির সংখ্যা ১২০০০-এর বেশি।

বাস্তুতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে জীববৈচিত্র্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একই বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে বসবাস করে। তাই প্রজাতির বৈচিত্র্য যত বাড়বে বা প্রজাতির সংখ্যা যত বাড়বে, সেই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য তথা স্থিতিশীলতা তত বাড়বে। বাস্তুতন্ত্রের যেকোনো একটি উদ্ভিদ বা প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ, সংশ্লিষ্ট উদ্ভিদ বা প্রাণী প্রজাতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত খাদ্য শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটা। তাই বাস্তুতন্ত্রের সার্বিক ভারসাম্য রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অনবদ্য ও অপরিসীম।

মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধপত্র প্রভৃতির জন্য সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্যের জন্যই মানুষ তার ক্রমবর্ধমান খাদ্যচাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম হয়। মানুষ বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে শুধু খাদ্যসামগ্রী পায় তাই নয়; ওষুধ, কাঠ, কাগজ, তন্তু, রাবার, আঠা, রজন, ট্যানিন, ফুলফল ইত্যাদিও পায়। তেমনই বৈচিত্র্যময় প্রাণী প্রজাতি থেকে মাছ মাংস, দুগ্ধসামগ্রী, চামড়া, পালক, উল, লাক্ষা, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করে। আবার, বিভিন্ন জীবাণুর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমেও বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী উৎপাদন করা যায়। এক কথায় খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মানুষ জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।

পরিবেশ দূষণ রোধ করতে জীবমণ্ডলের সার্বিক সংরক্ষণ ও কার্যকারিতা বজায় রাখার কারণে জীববৈচিত্র্য আবশ্যক। পরিবেশে অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় রাখতে, বৃষ্টিপাত ঘটাতে উদ্ভিদের ভূমিকা অপরিহার্য। জীববৈচিত্য হলো প্রকৃতপক্ষে বিপুলসংখ্যক জিনের ভাণ্ডার। বিভিন্ন জীবের এই জিন ভাণ্ডার মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। এই জিন ভাণ্ডারে অসংখ্য উত্তম গুণসম্পন্ন জিন রয়েছে, জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে যা সংগ্রহ করে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীতে স্থানান্তরিত করে পছন্দসই গুণসম্পন্ন উচ্চ ফলনশীল ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ ও প্রাণী তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এর দ্বারা মানবজাতির ক্রমবর্ধমান খাদ্যচাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।

যেকোনো দেশের জীববৈচিত্র্য সেই দেশের সম্পদ। বিভিন্ন প্রজাতির জীব, প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর করে তোলে। এই সম্পদের নমুনা চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষণের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানো হয়। ফলে নান্দনিক সৌন্দর্য ও শিক্ষাগত মূল্য বৃদ্ধি পায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে স্বাদু পানির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ এবং মাছের সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে।

মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়কে বাড়িয়ে তুলছে। যার ফলে, কোভিড-১৯-এর মতো জেনেটিক

(অন্য প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে আসা সংক্রামক ব্যাধি) রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।

জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশের হাওর, নদী, পুকুর, জলাশয়ে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ, পাখি ও বৃক্ষরাজি। কিন্তু বর্তমানে কিছু মানুষ ক্ষুদ্র ও সাময়িক স্বার্থে কারেন্ট জাল, নেট জাল ইত্যাদি ব্যবহার করে ছোট মাছ ধরছে ও পাখি নিধন করছে। বৃহত্তর স্বার্থে এসব কার্যকলাপ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের খাল, বিল, হাওর, বাঁওড় বা জলাশয় সব সময় নানা পাখপাখালিদের কোলাহলে মুখরিত থাকে। আর এই পাখিরা আমাদের পরিবেশের সৌন্দর্যকে আরো বহু গুণে বৃদ্ধি করে। কিন্তু একদল মানুষ আছে যারা এই পাখিদের শিকার করে তাদের ক্ষুধা নিবৃত করে। বিশেষ করে মৌসুমি শিকারিরা অতিথি পাখিদের শিকার করে বাজারে বিক্রি করে। পাখি যেমন দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তেমনি ভারসাম্য রক্ষায় তাদের গুরুত্ব অপরিসীম।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশের বিভিন্ন প্রাণীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়সহ প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ছাড়া পরিবেশকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যাপ্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

কিন্তু মানুষ নিজেদের ইচ্ছেমতো জলাভূমিগুলো ভরাট করছে। অথচ জলাভূমিগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়ের অভাব নেই, শুধু সংরক্ষণ করার অভাব! গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহরপর্যায়ে একের পর এক জলাভূমিগুলো ভরাট করা হচ্ছে। অথচ ‘প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০’ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা সম্পূর্ণ বেআইনি। আবার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বর্তমানে আইন অমান্য করে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছেন। এর ফলে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন বিশ্বের মানুষের কাছে অন্যতম এক আকর্ষণীয় স্থান। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রিয় আবাসভূমি এটি। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণী ও বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন, যা দেশের অহংকার। অথচ এ বনের অস্তিত্ব ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। এ বন নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা বলছেন জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার অন্যতম শক্তি সুন্দরবন। অথচ তেলের ট্যাংক ডুবে বনের অভ্যন্তরের পানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষিত হওয়া, চোরা শিকারি ও বনসংলগ্ন এলাকায় শিল্প-কারখানা নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলছে।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৌলিকনীতি হিসাবে সংবিধানে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ কার্যকর করা হয়েছিল। যে কটি দেশ জৈববৈচিত্র্য সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনটি বাস্তবায়নের জন্য আইন কার্যকর করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৭ সালেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ বায়োলজিকাল ডাইভারসিটি অ্যাক্ট’ পাস হয়েছে। বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডের ৫ শতাংশের বেশি এবং সমুদ্র অঞ্চলের প্রায় ৫ শতাংশ এলাকাকে ‘ঝুঁকিতে থাকা’ এবং সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে।

প্রত্যেক জীবের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের বিশ্বপ্রকৃতির ঘোষণাপত্রে এই চিন্তাধারা স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য প্রতিটি প্রজাতির জীবকে বাঁচিয়ে রাখা। এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও গুরুত্ব সম্বন্ধে মানুষজনকে সচেতন করা।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close