অলোক আচার্য

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

অশান্ত বিশ্বে শান্তি দিবস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে পৃথিবী অনেক বেশি সংঘাতপূর্ণ, অশান্ত, অস্থিতিশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু হয়ে মাত্র কয়েক দিন আগেই নাগারানো-কারাবাখ ঘিরে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংঘর্ষ, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধই শুধু নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা পৃথিবীকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ সমস্যা যেতে না যেতেই আবার যুুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে মধ্য এশিয়ায়। প্রতিবেশী দুদেশ কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। দুদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াইের খবর পাওয়া গেছে।

এক কথায় পুরো বিশ্বই উত্তপ্ত। বিশ্বনেতারা শান্তির পথে হাঁটার কথা বললেও চলছে উল্টোপথে। অর্থাৎ মুখে এক কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। পৃথিবী এরই মধ্যে দুটি বলয়ে ভাগ হয়েছে। একদিকে মার্কিন বলয়, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন। সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে শান্তি একটি কাঙ্ক্ষিত কিন্তু প্রায় অধরা শব্দ। পরাশক্তিগুলোর টানটান উত্তেজনা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। বিশ্ব শান্তি দিবসে তাই বিশ্বনেতাদের হিসাব করার সময় এসেছে বিশ্ব আজ কতটা শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং অস্ত্রের মহড়া বন্ধ না হলে প্রকৃতপক্ষে শান্তি অধরাই থেকে যাবে। বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, শরণার্থী সংকট, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধাবস্থা প্রভৃতি বিশ্বকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বিশ্ব শান্তি দিবস। পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, হিংসা,আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগের মতো ঘটনা মুছে ফেলতেই প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর দিনটি পালন করা হয়। তবে, যে উদ্দেশ্যে বিশ্ব এই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। কারণ অস্ত্র এবং তা নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এখন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতপক্ষে শান্তি চায়। কিন্তু শান্তি বজায় রাখার পথে বিশ্ব হাঁটছে না। যুদ্ধ এবং উত্তেজনা শান্তির অন্তরায়।

মূলত নিজের আধিপত্য জানান দিতেই এ অবস্থার সৃষ্টি। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং কেউ তার নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে সম্মত নয়। ইয়েমেনের জন্য আমরা গত কয়েকটি বছরে কী করতে পেরেছি! রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে মিয়ানমার অশান্তির আগুন জে¦লে দিয়েছে। সমাধান কোথায় কারো জানা নেই। অন্যায্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যত অশান্তির জন্ম হচ্ছে। ফল ভোগ করতে হচ্ছে সারা বিশ্বকেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অভ্যন্তরীণ শান্তির জন্য অবিরত কাজ করে গেলেও শান্তির দেখা মিলছে না।

করোনা মহামারির চেয়ে বিশ্বে ক্ষমতা প্রয়োগের মানসিকতা মানুষের ধ্বংসের জন্য বেশি দায়ী। সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা। প্রত্যেকেই যার যার মতো করে নিজের সুরক্ষায় ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রে কোনো দেশই পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকেই নিজেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা করে।

দুর্বল বা সবল কোনো দেশ এ ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি নয়। প্রয়োজনে মিত্র দেশের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়েও নিজেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। যুদ্ধ আসলে মানবসভ্যতাকে কোনো দিনই ভালো কিছু দিতে পারেনি, যা দিয়েছে তা হলো মানবিক যন্ত্রণা, যা দীর্ঘ মেয়াদে নারী-পুরুষ ও শিশুরা ভোগ করছে। দিয়েছে অশান্তি, যার আগুনে পুড়েছে পুরো মানবসভ্যতা। অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পরাধীন জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ তাদের দায় কেউ নিতে রাজি নয়।

দেশগুলো নিজেদের ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশই অস্ত্র প্রতিযোগিতার পেছনে ব্যয় করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই হিসাব অনেকটা বদলে গেছে। প্রতিরক্ষা খাত আরো বেশি শক্তিশালী করতে এ খাতে আরো বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। আধুনিক অস্ত্র কিনতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। অনেক দেশে সামরিক খাতের ব্যয় অনেক বেশি। কিন্তু কেন এই প্রতিযোগিতা! আমরা কার কাছ থেকে নিরাপদে থাকতে চাইছি!! আমাদের প্রধান শত্রু কে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা আবশ্যক। সময় এসেছে আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করার। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা বা অন্যকে ভয় দেখানো যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমরা মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। পৃথিবীর অস্তিত্বই যদি হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে নিজেকে সুরক্ষিত করার কোনো অর্থ হয় না।

আজকের যে আক্রমণাত্মক প্রবণতা তা অতীতেও ছিল। যখন রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো আর উলুখাগড়ার প্রাণ যেত। তারাও তাদের শক্তিমত্তা জানান দিতে প্রায়ই অন্য দেশ আক্রমণ করত। যুদ্ধের নতুন নতুন কৌশল বের করত। নতুন নতুন অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করত। মানুষকে মারার জন্য মানুষের এত কৌশল! সে সময়ও ছোট রাজ্যগুলো একজোট হয়ে বড় রাজ্যকে প্রতিহত করত। সেই কৌশলের আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি।

যুদ্ধ এবং শান্তি পরস্পর বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বে দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলছে। একদিকে একে অন্যকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য ছুড়ছে, অন্যদিকে শান্তির বুলি। মানুষ আসলে কি চায় তা মনে হয় নিজেও জানে না। যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা? এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না।

প্রত্যেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়াতেই ব্যস্ত। এসব করতে গিয়ে পৃথিবীর কী হবে তা নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমরা কি নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলব? না, তা হারাতে পারি না। জরুরি পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করা। ধ্বংস দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ক্ষমতার আধিক্যের এই যুগে শান্তি প্রক্রিয়া কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে- সেটাই এখন একটি প্রশ্ন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close