আশীষ কুমার দত্ত

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পর্যালোচনা

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা

২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করা হবে। অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে প্রাথমিক স্তর। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো অবকাঠামোগত আবশ্যকতা মেটানো এবং প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা।

দ্বিতীয়টি হলো প্রাথমিক শিক্ষায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক-নির্দেশিকা প্রণয়ন করা। শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে ছেলেমেয়ে, আর্থসামাজিক অবস্থা ও জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব শিশুর জন্য পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়। যা প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ধারাবাহিক ও সমন্বিত শিক্ষাপ্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এটি এত দিনেও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, পুরো বিষয়টি হতাশাজনক।

১১ বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষান্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার কাজ চলছে তবে কাজের কাজ হয়নি কিছুই। উল্টো নতুন শিক্ষাক্রমেও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই প্রাথমিকের স্তর থাকছে । আবার শিক্ষানীতি-২০১০ও বহাল রাখা হয়েছে যদিও এ দুটি সিদ্ধান্ত পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতায় পড়েছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাইলটিং ভিত্তিতে বেশকিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু হলেও অর্থ সংকট, অবকাঠামো ও শিক্ষক সংকট আর শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখাই নীতি বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হয়ে সামনে এসেছে। এ অবস্থায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে পুনরায় ২০২১ সালকে ‘টার্গেট বছর’ নির্ধারণ করা হয়।

প্রত্যন্ত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু হওয়ায় এলাকাভিত্তিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা সুফল বয়ে এনেছে। দরিদ্র এলাকার শিক্ষার্থীরা অন্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষার ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পারছে। এমতাবস্থায় এলাকায় অষ্টম শ্রেণি চালু না হলে হয়তো পঞ্চম শ্রেণিতেই লেখাপড়া শেষ হয়ে যেত। গ্রামে বাল্যবিবাহ রোধে এটি অনেকাংশে সফল হয়েছে।

নীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে সারা দেশের হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভয়াবহ অবকাঠামো সংকট। খোদ রাজধানীতেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা বেহাল। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শিশুদের উপযোগী শ্রেণিকক্ষ। যাদের আছে তাও আকারে ছোট।

শিক্ষানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে নানা সংকটের কারণে বর্তমানের চালু রাখাই দায়। জটিলতা উত্তরণের চিন্তা ছাড়াই এতদিন ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, যাকে ভুল চিন্তা বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু কী কী সমস্যা আসলে সামনে চলে এসেছে? কেন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাচ্ছে? জানা গেছে, নীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে সারা দেশের হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভয়াবহ অবকাঠামো সংকট। সঙ্গে আছে শিক্ষক সংকট ও শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা চ্যালেঞ্জ। তবে এরই মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করার কাজ শুরু করেছে।

২০১৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৭৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির অনুমোদন দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষকও দেওয়া হয়নি। ফলে অনেক বিদ্যালয়ে এসব শ্রেণি চালু রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। সাত বছর আগে শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। শিক্ষানীতির বিভিন্ন অংশ বাস্তবায়ন শুরু হলেও এর উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নির্ধারণ নিয়েই বেঁধেছে জটিলতা।

এক কথায় বলতে গেলে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’ এমনই অবস্থা সারা দেশে অষ্টম শ্রেণি চালু বিদ্যালয়ে। সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত দেশের এ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। এসব বিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ হলেও ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি অর্থাৎ জুনিয়র হাই স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো ও অর্থের সংস্থান কোনোটাই নেই। বিকল্প পদ্ধতির বর্তমান পাঠদানের জন্য প্রাথমিকের বাড়ির কাজের পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অ্যাসাইনমেন্ট বিতরণ করতে গিয়ে ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা এসব বিদ্যালয়ের। দেখার কেউ নেই, নেই কোনো পরিত্রাণদাতা। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে কিছু বিদ্যালয়কে দেওয়া হয়েছে ইআইআইএন নম্বরও। শিক্ষা বোর্ডের কাছে বরাবরই এসব বিদ্যালয় থাকে উপেক্ষিত, দায়িত্ব নেয় না প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। না ঘরকা, না ঘটকা অবস্থা এসব বিদ্যালয়ের। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১৪টি করে তিনটি শ্রেণিতে বিষয়ের সংখ্যা ৪২টি। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪২টি বিষয়ের শ্রেণি কার্যক্রম চালানোর চ্যালেঞ্জ দূর করার বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শুরু থেকে অদ্যবধি পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মিত হয়নি। নতুন শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হয়নি। সরকারি প্রাথমিকের আছে অনেক সংগঠন কিন্তু অষ্টম শ্রেণি চালু বিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপনে কেউই তেমনভাবে এগিয়ে আসেননি। সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যেও তেমন কোনো ঐক্য গড়ে ওঠেনি। কর্তৃপক্ষও স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেনি সমস্যা সমাধানে।

সব সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধানে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও ডিপিই মহাপরিচালকের হস্তক্ষেপ কামনা করি।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, মেরাখোলা

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লামা, বান্দরবান

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close