জান্নাতুল মাওয়া নাজ

  ১১ মার্চ, ২০২১

মুক্তমত

মাটিদূষণ ও প্রতিকার ভাবনা

মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আর এ উদ্ভিদ তথা গাছ তাদের পুষ্টির জন্য মাটির ওপর নির্ভর করে। গাছ তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান (খনিজ পদার্থ) মাটি থেকে সংগ্রহ করে। তাই মাটি ছাড়া আমাদের খাদ্যের কোনো বিকল্পব্যবস্থা সম্ভব নয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের যেসব বস্তুর প্রয়োজন হয়, তার সবগুলোরই উৎস মাটি। আমরা মাটিকে আমাদের জীবনের একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মনে করে। তবে মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে এ মাটির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, তথা মাটি দূষিত হচ্ছে।

মাটিদূষণ বলতে বোঝায়, মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থগুলোর সঞ্চয়, যা বর্তমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর। অবাঞ্ছিত পদার্থ বলতে সেসব উপাদানকে বোঝায়, যা মাটির নেতিবাচক রূপান্তর ঘটায়। মাটিদূষণ পরিবেশদূষণের একটি প্রধান অংশ। নগরায়ণ ও ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিই মাটিদূষণের প্রধান কারণ। মাটিদূষণের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে :

১. ভূমি ক্ষয়। ২. রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ। ৩. অপরিকল্পিত নগরায়ণ। ৪. অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন। ৫. অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ। ৬. চিংড়ি চাষ ও ৭. অনিয়নন্ত্রিত কৃষিকাজ।

ভূমিক্ষয় : ভূমিক্ষয়ের প্রধান কারণ বৃষ্টি ও বায়ুপ্রবাহ। ভূমিক্ষয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যখন মানুষ নির্বিচারে গাছপালা কেটে বন উজাড় করে, তৃণভূমিতে চাষাবাদ শুরু করে এবং মাটির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে গাছপালা কেটে ফেলে, ফলে মাটি আলগা হয়, তখন বাতাস সহজে মাটি উড়িয়ে নিয়ে ভূমিক্ষয় ঘটায়। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি দ্বারা উন্মুক্ত স্থানের ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায়। এভাবে ভূমিক্ষয়ের ফলে সৃষ্টি হয় প্রচুর পলির। জমি চাষের ফলে ভূমিক্ষয় ত্বরানি¦ত হয়, কেননা জমি চাষের ফলে মাটি আলগা হয়, তখন বৃষ্টির পানি ও বায়ুপ্রবাহ সহজেই এক স্থানের মাটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে। এ ধরনের উৎস থেকে সাধারণত সবচেয়ে বেশি পলি এসে থাকে। এ ছাড়া কিছু পলি আসে এমন মাটি থেকে, যেখানে কোনো গাছপালা নেই।

রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ : শিল্প কল-কারখানা থেকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বর্জ্য হিসেবে নির্গত হয়। এ ছাড়া গ্রাম বা শহরের গৃহস্থালি বর্জ্য ও নাগরিক বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্তূপ করা হয়। এসব বর্জ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থসহ রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণু থাকে, যা বর্জ্য স্তূপকৃত স্থান ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানকে দূষিত করে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে ঢাকা শহরের হাজারীবাগের ট্যানারির কথা। এক হিসাবে দেখা গেছে, এখান থেকে গড়ে প্রতিদিন ১৯০০০ ঘনমিটার পানিতে তিন শতাধিক বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দ্রবীভূত অবস্থায় বের হচ্ছে। নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে এ তরল বর্জ্যরে অমø ও ক্ষারত্বের তারতম্য যথাক্রমে ১.৫ থেকে ১৩ ঢ়য মাত্রায় থাকে। এ তরল বর্জ্য ট্যানারি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিকে মারাত্মক দূষিত করেছে, ফলে এ এলাকার মাটিতে জন্মানো ঘাস পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ : বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এরই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের শহরমুখী বসবাস। এ কারণে বিশ্বের প্রতিটি দেশের শহরের জনসংখ্যা ঘনত্ব দিন দিন বাড়ছে। ১৯৫০ সালের পরবর্তী ৩৫ বছরে বিশ্বে শহরবাসী লোকের সংখ্যা ১.২৫ বিলিয়ন (১২৫ কোটি) থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিন গুণ হয়েছে। অধিকতর উন্নত দেশসমূহে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে তা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপকসংখ্যক শহরবাসীর চাহিদা পূরণার্থে শহরে গড়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিত পাকা-বাড়ি, সুউচ্চ ফ্ল্যাট বাড়ি এবং যেখানে-সেখানে শিল্প কল-কারখানা। এভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প কল-কারখানা ও ফ্ল্যাট বাড়ি ওঠাতে দূষিত হচ্ছে শহুরে পরিবেশ। এমনিভাবে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে ওঠাতে ভেঙে পড়ছে শহরের বর্জ্য নিষ্কাশন ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। এসব বর্জ্য দ্বারা শহরাঞ্চল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি, পানি ও বাতাস হচ্ছে দূষিত।

অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন : জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বৃক্ষ কর্তনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান, রাস্তাঘাট, কল-কারখানা তৈরি করতে বনভূমি ও কৃষিজমি ব্যবহার করা হয়, ফলে বনভূমিতে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং মাটি উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। মাটি উন্মুক্ত হওয়ায় মৃত্রিকা ক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে মাটি তার পুষ্টি উপাদান হারাচ্ছে, তথা মাটিদূষণ ঘটছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সেখানে মরূকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ : ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর নাব্যতা কমে গেছে এবং নদীতে স্রোত কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের লোনাপানি অধিক ভেতরে প্রবেশ করছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে মাটির লবণাক্ততাজনিত মাটিদূষণ শুরু হয়ে গেছে।

চিংড়ি চাষ : চিংড়ি বাংলাদেশের একটি মূল্যবান রপ্তানিযোগ্য সম্পদ। এ কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা সাতক্ষীরা, খুলনা ও কক্সবাজার এলাকায় ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। চিংড়ি চাষে অনেক দিন লোনা পানিবদ্ধ অবস্থায় থাকে বলে লবণাক্ততাজনিত কারণে মাটি দূষিত হচ্ছে।

কৃষি কর্মকান্ড : কৃষিকাজে অধিক ফসল ফলানোর জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছিটানো হয়, এর দ্বারা মাটি দূষণ ঘটে। যেকোনো কৃষিকাজই মাটির পুষ্টি উপাদান নষ্ট করে থাকে। মাটি চাষাবাদের সময় মাটি আলগা হয়ে পড়ে এবং মাটিক্ষয়ের মাধ্যমে মাটিদূষণ ঘটে। এ ছাড়া জমি চাষকালে মাটির কাঠামো নষ্ট হয়। মাটির কাঠামো (বুনট) নষ্ট হলে গাছ জন্মাতে অসুবিধা হয়।

এদিকে ভূমিক্ষয়ের ফলে ভূমির উপরিভাগ থেকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান অন্যত্র সরে যায়। ফলে উক্ত জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে, যা গাছপালা জন্মানোর অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং উক্ত এলাকা ক্রমান¦য়ে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ মাটিকে দূষিত করে, ফলে সে এলাকায় কোনো উদ্ভিদ ও প্রাণী জন্মাতে পারে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি মাটিদূষণ ঘটে, যা মানুষসহ অন্যান্য জীবের বসবাসের অনুপযোগী হয়। এর দ্বারা মানুষ বিভিন্ন রোগেও আক্রান্ত হয়। পাশাপশি ব্যাপক হারে বৃক্ষনিধনের ফলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সেখানে গাছপালা জন্মাবার পরিবেশ নষ্ট হয়, যা মরূকরণকে প্রভাবিত করে। ফারাক্কা বাঁধ যার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের সবগুলো নদীতে পানির স্রোত হ্রাস পেয়েছে এবং নদীগুলো দিন দিন তাদের নাব্যতা হারাচ্ছে। এর দ্বারা নদী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিদূষণের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই। আমরা জানি, আলগা মাটি সহজে ক্ষয় হয়ে থাকে। এজন্য আলগা মাটিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘাস বা অন্যান্য উদ্ভিদ লাগানো উচিত। ব্যাপক হারে বৃক্ষনিধন বন্ধ করা দরকার। গাছ কাটার প্রয়োজন হলে পাশাপাশি গাছ লাগানোর উদ্যোগও নিতে হবে। নগর বা গ্রামের গৃহস্থালির বর্জ্য ও সিওরেজ বর্জ্য স্থানান্তর পূর্বে পরিশোধিত (ৎবপুপষরহম) করে নিতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ বন্ধ এবং চিংড়ি চাষের বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে কল-কারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য ভূমি, জলাশয় বা নদীতে নির্গমনের আগে পরিশোধিত করতে হবে। এ ছাড়া জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার, জীবাণু সার ব্যবহার করতে হবে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে শিম-জাতীয় উদ্ভিদ জন্মানো যেতে পারে। জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করা এবং এর পরিবর্তে জৈব প্রক্রিয়ায় কীটপতঙ্গ দমন করা যেতে পারে। সবকিছুর সঙ্গে মাটিদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করাকেও অন্যতম একটি কাজ বলে গ্রহণ করতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহ সঞ্চয়, যা বর্তমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর; মাটির এ অবস্থাই মাটিদূষণ। যে কারণেই দূষণ হোক না কেন, পৃথিবীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক বসবাস উপযোগী করার জন্য মাটিদূষণ রোধ খুবই জরুরি।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক

দ্য এনভায়রনমেন্ট রিভিউ-ম্যাগাজিন

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close