পঞ্চানন মল্লিক

  ১৩ জুলাই, ২০২০

নিবন্ধ

কমে যাচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা

আমরা যেন পরমতে দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। এর পরিবর্তে বেড়ে যাচ্ছে নিজ মত অপরের ওপর জাহিরের প্রবণতা। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেখা যাচ্ছে এসব। জেনে হোক আর না জেনে হোক নিজের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অন্যরা যেন সেটা মেনে চলে এমনটি প্রত্যাশা করছি আমরা অনেকেই। কোনো বিষয়ে আমি যেটা বুঝছি, সেটা সঠিক আর অন্যরা যেটা ভাবছে, সেটা সঠিক নয়Ñ এমন মনোভাবসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে হানাহানি, দলাদলি, বিশৃঙ্খলা। এখন একাধিক ব্যক্তি এক জায়গায় মিলিত হলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক বা ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। কোনো একটি বিষয়ে একজন এক রকম বললেই আরেকজন বলছে অন্যরকম। জানুক বা না জানুক নিজেকে সে বিষয়ে অন্যের তুলনায় বেশি অভিজ্ঞ প্রমাণ করতেই যেন সবাই ব্যস্ত। এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে আজকাল সর্বত্রই।

আগেকার দিনে দেখা যেত গ্রামে যে সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, সেখানে একজন সমাজপতি বা মাতব্বর থাকতেন। তাকে সবাই সমাজের সবচেয়ে বুঝমান ব্যক্তি মনে করতেন। অন্য সবাই তাকে মেনে চলতেন। তিনি কিছু করতে বললে সবাই সেভাবে কাজ করতেন। সে কারণে সমাজে অনেকটা শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকত। কোনো কাজ করতে গেলে আগে গ্রামের লোকজন সেখানকার ময়মুরব্বি ও মোড়ল মাতব্বরদের পরামর্শ নিতেন। ছোটরা বড়দের পরামর্শ নিয়ে কোনো কাজ করতেন। সামাজিক নিয়মকানুন, শান্তি-শৃঙ্খলার দিকে সবাই বেশি গুরুত্ব দিতেন। কোনো কাজে যেন বিশৃঙ্খলা না ঘটে; সেদিকে নজর রেখে ময়মুরব্বিদের কথা মেনে চলতেন। অপরের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। সবাই কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন। এতে সমাজে সবার মঙ্গল সূচিত হতো। মানুষ নিরাপদে, শান্তিতে, আনন্দের মধ্য দিয়ে সমাজে বাস করার সার্বিক পরিবেশ পেত।

দিন যত যাচ্ছে তত বদলে যাচ্ছে মানুষের সমাজ মানার প্রবণতা, অন্যকে মানার প্রবণতা যেন কমে আসছে। এখন আর কেউ কাউকে যেন মেনে চলতে রাজি না। যার যার মতো চলা, যার যার মতো বলাÑ এই যেন এখনকার নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোনো একটি বিষয়ে যে আদৌ অভিজ্ঞ না, সেও নিজেকে সে বিষয়ে জ্ঞানী মনে করে তার নিজের মতো করে কাজটি করার চেষ্টা করছে। ফলে মানুষের সমষ্টিগত চিন্তাচেতনা ও কাজকর্মে চিড় ধরছে। আগে এলাকায় এলাকায় যেভাবে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সবাই একসঙ্গে মিলে কোনো কাজ করত, সামাজিক কাজে একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করত, পরপর যেন সেসব অনেকটা কমে যাচ্ছে। এখন দশজন এক জায়গায় মিলিত হলে তাদের মতামত হয় একেক রকম। ফলে একত্রিত হয়ে কোনো কাজ করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয় না। দলাদলি বা বিভাজ্যতা প্রকট আকার ধারণ করছে। একটু মতের ভিন্নতা হলেই সবাই আলাদা হয়ে যায়। ফলে দেখা যায় সমাজে একতার পরিবর্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে সবাই বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে রেষারেষি, হিংসা-বিদ্বেষ প্রবল আকার ধারণ করছে। একটা কথা প্রচলন আছে, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। এটা জেনেও আমরা যেন তা মানার ব্যাপারে দিনকে দিন অনেকটা বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি। কোনোভাবেই যেন একতা টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। আগের দিনের পারস্পরিক একতার পরিবর্তে মানুষ এখন অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এখন মানুষ অন্যের খোঁজ রাখার পরিবর্তে অনেক বেশি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কোনো কাজে এখন কেউ আর কাউকে তেমন মূল্যায়ন করতে চায় না। একজন কিছু করলে অন্যরা তা ভিন্নভাবে করার চেষ্টা করে বা ভিন্ন চোখে দেখে। কেউ কেউ অন্যের ভালো কিছু দেখলে তা নস্যাৎ করার জন্য লেগে যায়। একজনের খ্যাতি অন্যের চোখের বিষকাটা হয়। অপরের প্রশংসার পরিবর্তে তাকে দাবিয়ে নিজে কি করে ওপরে ওঠা যায়, সে কাজে লিপ্ত হয়। নিজেকে সেরা ভাবার প্রবণতা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। নিজে যেটা করছি সেটাই শ্রেষ্ঠ অন্যরা নগণ্য, এই ভাবনা মানুষের মনকে গ্রাস করছে। এই হীনম্মন্যতা দিনকে দিন আমাদের অনেক নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। একটা কথা সত্য যে, আমি যদি সর্বক্ষণ কারো অমঙ্গল কামনা করি, কাউকে অবমূল্যায়ন করি তাহলে সেও তো আমার অমঙ্গল বা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। এর ফলে আমরা উভয়েই তো ক্ষতিগ্রস্ত হব। অতএব আমাদের একতাই পারে আমাদের সার্বিক কল্যাণের পথ দেখাতে পারে আর বিভেদ বা বিচ্ছিন্নতা ডেকে আনে ধ্বংস। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার পরিবর্তে যদি যোগ্য সম্মান দেখাতে পারি, তাহলে সেও তো এক দিন আমার উপকারে আসতে পারে। এ কথা কেন ভুলে যাই আমরা।

জ্ঞান মেধা এগুলো তো তুচ্ছ কোনো বিষয় না। প্রকৃত জ্ঞানের কাছে মস্তক অবনত করা আদৌ তো অপমানের কিছু নয়। বরং নিজের অজ্ঞ ধারণাকে অপরের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই লজ্জাজনক। মানুষের জীবনে কি শেখার কোনো শেষ আছে। অজ্ঞানতার অন্ধকারে না থেকে কারো কাছ থেকে যদি সঠিক জিনিসটি শিখতে পারি; তাহলে তো সবচেয়ে বড় লাভবান হব আমরা নিজেরাই। আর প্রতিভা তো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিষয়। কেউ একজন যে মেধা নিয়ে জন্মেছে তা কোনোভাবেই কি দমিয়ে রাখা যায়? যার যে মেধা আছে, সে সেই বিষয়ে এগিয়ে যাবে, বড় হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কোনোভাবে অজ্ঞতা দিয়ে কি তাকে ঢেকে রাখা যাবে? জ্ঞান মেধা তো সবার সমান না। অন্যের ভেতরে যে মেধা আছে, আপনি তার মূল্যায়ন করলে আপনার কোনো প্রতিভার বিকাশে হয়তো সে আপনাকে সহযোগিতা করবে। তখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে আমরা সবাই অবদান রাখতে পারব। অপর পক্ষে অপরকে মূল্যায়নের পরিবর্তে যদি তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করি তাহলে তা হবে একটি অনৈতিক কাজ। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের সমাজ। আর যাই হোক আদর্শ মানুষ হিসেবে আমরা কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সংকীর্ণতার জালে জড়িয়ে নিজ চরিত্রকে কলুষিত করা মানুষের জন্য একেবারেই অনুচিত। তাই অপরের মতামতকে আমাদের গুরুত্ব দিতে শিখতে হবে। আমরা যখন একজন আরেকজনকে জানতে ও বুঝতে শিখব; তখন পৃথিবীটা অনেক শান্তিময় হবে। সব সময় শুধু নিজের মতকেই গুরুত্ব দিতে হবেÑ এমনটি নয় বরং অপরের মতকে আমরা কতটা গুরুত্ব দিতে পারছি, সেটাই একজন ভালো মানুষ হিসেবে আমাদের যোগ্যতার মাপকাটি হওয়া উচিত। অহেতুক তর্কের খাতিরে তর্কে লিপ্ত না হয়ে যেটি সমাজের সবার জন্য হিতকর, সেটি সহজে মেনে নিয়ে আমাদের চলতে হবে। তাতে তো অপরের সঙ্গে নিজেরও মঙ্গল সাধিত হবে, সমাজ ও দেশের মানুষের কল্যাণ সাধিত হবে। তাই পরমতে অসহিষ্ণু না হয়ে আসুন নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করে সমাজের হিতকর প্রকৃত জ্ঞানান্বেষণে সবাই ব্রতী হই।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close