এস এম মুকুল

  ২০ জুলাই, ২০১৯

নিবন্ধ

এক দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ

জীবনে সফলতা সবাই চায়। কিন্তু সেই সফলতার জন্য নিজের মাঝে কী কী গুণাগুণ থাকা উচিত; সে ব্যাপারটা অনেকেরই অজানা থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন প্রমাণ করেছেন, ব্যর্থতার মাধ্যমেই সফলতা আসতে পারে। চলার পথে হারের পর হার। ২৩ বছর বয়সে চাকরি হারান এবং রাজনীতিতে পরাজিত হন। ২৪ বছর বয়সে ব্যবসায় ব্যাপক লস করেন। ২৬ বছর বয়সে প্রিয়তমাকে হারান। ২৭ বছর বয়সে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়। ২৯ বছর বয়সে স্পিকার পদে পরাজিত হন। ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেস প্রার্থী নিবার্চনে হেরে যান। ৩৯ বছর বয়সে আবার কংগ্রেস প্রার্থী নির্বাচনে হেরে যান। ৪০ বছর বয়সে ভূমি অফিসার পদ হারান। ৪৫ বছর বয়সে সিনেট নির্বাচনে হেরে যান। ৪৭ বছর বয়সে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনে হেরে যান। ৪৯ বছর বয়সে আবার সিনেট নির্বাচনে হেরে যান। কিন্তু এত হারের পরেও ৫২ বছর বয়সে তিনি হলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত হার বা পরাজয়ের পরও তিনি কখনো ভাবেননি রাজনীতি তার জন্য নয়। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলেই তিনি হতে পেরেছিলেন আমেরিকার সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্টের একজন। আব্রাহাম লিংকন আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে র্ব্যথতাকে হারাতে হয়। ব্যর্থতা মানে নিচে পড়ে যাওয়া নয়, নিচে পড়ে যাওয়ার পরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা না করা হলো র্ব্যথতা।

বিজনেস ইনসাইডারে প্রকাশিত বিবৃতিতে প্রযুক্তি দুনিয়ার অন্যতম পথিকৃৎ স্টিভ জবস বলেছেন, ৪০ পেরোনোর আগেই সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন। প্রিয়তমার প্রতি প্রেম এবং কাজের প্রতি ভালোবাসার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই বলেই মনে করতেন স্টিভ। জানা গেছে, বয়স ৪০ পেরোনোর আগেই স্টিভ বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতেন। জবসের মতে, বিশ্বাস এবং ভালোবাসা ছাড়া কাজ করলে কখনো সফল হওয়া যায় না। মনের মতো একটি কাজ বেছে নিন। তা হলে কাজের প্রতি ভালোবাসা আসবে। দেখুন জবস বিশ্বাস করতেন ছোট ছোট জিনিসও বহুমূল্য রাখে। আইডিয়া দারুণ বিষয়। কিন্তু এর নিয়মতান্ত্রিক বাস্তবায়ন এবং ভিন্ন বিষয় একতাবদ্ধকরণ ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়। স্মার্টফোনে কলম ব্যবহারের জন্য স্টাইলাস এখন কে চান? কেউই তা আর ব্যবহার করতে চান না। কিন্তু এমন একটি জিনিসকে সরিয়ে দিলে তা হারিয়ে যাবে। খুব সাধারণ একটি যন্ত্র। কিন্তু বহু কাজকে সহজ করে দিয়েছে একটি স্টাইলাস। কাজকে সহজ করতে একটি সাধারণ উপাদানও বহু প্রয়োজনীয়। ক্রেতার চাহিদা তাৎক্ষণিক তৃপ্তি দেয়। বহু প্রযুক্তির মিশেলে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে চাইলে এর প্রয়োজন নিয়মশৃঙ্খলা। কারণ এটি ছাড়া বছরের পর বছর উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানো যাবে না বলেই মনে করতেন স্টিভ। যেকোনো দুটি ধারাকে এক করতে যারা চান, তারাই সফল হতে পারেন। স্টিভের তিন বছর লেগেছে নেক্স কম্পিউটার বানাতে। কিন্তু ক্রেতারা তা চাননি। তারা এমন জিনিস চেয়েছিলেন, যা এক বছর হয়তো ব্যবহার করতে ভালো লাগত। কিন্তু তারপর আর চাহিদা থাকত না। তাই ক্রেতার চাহিদা সব সময় ঠিক হয় না। এ মন্ত্র ধারণ করতেন স্টিভ। ক্রেতার চাহিদাকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং ক্রেতার দীর্ঘদিনের তৃপ্তির কথা বিবেচনা করে এগোতে হবে আপনাকে। নয়তো দীর্ঘমেয়াদে সফলতা ধরে রাখতে পারবেন না। জবস ঠিকই মনে করতেন, প্রযুক্তি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষার ধরনও পাল্টে গেছে। মানুষের প্রতি আপনার বিশ্বাস থাকতে হবে। কারণ একমাত্র মানুষই স্মার্ট এবং বুদ্ধিমান। তাদের হাতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তুলে দিলে তারা যেন বিস্ময়কর সব কাজ করে দেখাতে পারে। এ ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন স্টিভ। সত্যিকার অর্থেই আজকের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মানুষ ছাড়া সম্ভব হতো না। তাই বিনিয়োগকারী, কর্মী বাহিনী এবং ক্রেতার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে।

সফলতার যদি কোনো গোপন রহস্য সম্পর্কে হেনরি ফোর্ড বলেছেন, অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝতে পারা এবং তার সমস্যাগুলো তার চোখ দিয়ে তার মতো করেই দেখতে পারা যেমনটা আমরা নিজের সমস্যাকে দেখতে পাই; সেটাই সফলতার গোপন মন্ত্র। কার্নেগীর মতে, সফল মানুষ অন্য মানুষকে ভুল পথ দেখিয়ে ভ্রান্ত করে না; বরং সঠিক পথ দেখিয়ে তার উপকার করে। ১৯৩৬ সালে ডেল কার্নেগীর ‘How to win friends and influence people’ নামক বইটি প্রকাশিত হয়। মানুষের মনস্তÍত্ত্ব বুঝতে হলে এই বইটির জুড়ি নেই বলে আজও ধারণা করা হয়। বইতে কার্নেগী লিখেছেন, সফল হওয়ার জন্য প্রথমে একজন ভালো বন্ধু হোন আপনার আশপাশের সবার। আপনার জনপ্রিয়তা ক্যারিয়ারেও আপনাকে সফলতা এনে দেবে। ডেল কার্নেগীর মতে, মানুষকে প্রভাবিত করার সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায় হলো তাদের জীবনের না পাওয়াগুলো নিয়ে কথা বলা এবং তাদের সঠিক পথ দেখানো। আপনার চারপাশের মানুষকে আপনি যত বুঝতে পারবেন; তত তাদের প্রয়োজন কী, চাহিদা কীÑ এই বিষয়গুলো আপনার নখদর্পণে চলে আসবে। কার্নেগীর মতে, যার আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব রয়েছে; সে অন্যকে বোঝার এবং ক্ষমা করার মানসিকতা রাখে। অপরপক্ষে বোকারাই সমালোচনা, অভিযোগ আর নিন্দা করে সময় নষ্ট করে। কার্যক্ষেত্রে আপনার সহকর্মী বা নিম্নপদস্থদের চাহিদা বুঝে আপনি এগিয়ে যেতে পারবেন। আপনি যদি সমালোচনার পথ বেছে নেন; তা হলে অন্যের ভুলগুলো আরো বেশি চোখে পড়বে। আপনার প্রতিযোগী থাকবেই। নিন্দা না করে বরং ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন তাদের সঙ্গে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানে মূল কাজ তুলে আনেন কর্মীরা। তাদের কাজের সঠিক প্রশংসা করুন। তবে অবশ্যই একজনকে ছোট করে আরেকজনের প্রশংসা করবেন না। আপনার এই অভ্যাস আপনার কর্মীদের মধ্যে আন্তরিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি আপনার প্রতিটি প্রজেক্টে কাজের গতি বাড়িয়ে এনে দেবে সফলতা। সফল মানুষ তাদের কর্মীদের ভালো কাজের প্রশংসা করেন মন খুলে। তাদের যোগ্যতার মূল্যায়ন করেন, দেন প্রাপ্য সম্মান এবং সম্মানী। কার্নেগী দেখেছেন, যোগ্যতার মূল্যায়ন মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে অনবরত সমালোচনা একটা মানুষের স্বপ্নকে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। উপযুক্ত সম্মান মানুষের বিশ্বস্ততা বাড়ায়, আনুগত্য বাড়ায়।

আপনাকে সচেতনভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকায় সচেষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখবেন, পেশাগত জীবনে সফলতার ব্যাপারটি কৌশলগত বিষয়। শুধু সততা দিয়ে, শুধু দায়িত্ব পালন করে কোনো পেশায় সফলতা অর্জন করা যায় না। মনে রাখবেন, অন্যের কথাবার্তার সমালোচনা করা থেকে নিজের আদান-প্রদানের একটি রীতি তৈরি করে নেওয়াই ভালো। এটা ধরে নিয়েই আপনাকে এগোতে হবে যে, অন্যদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য আপনার থেকে আলাদা হবে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তিই ‘সঠিক’ আচরণ করছেন এই ইতিবাচক মনোভাব যেন আপনার থাকে। নিজের সম্পর্কে প্রত্যেকরই একটি নির্দিষ্ট ধারণা আছে। এমন ধারণা থাকার তিনটি দিকও রয়েছেÑ এক. নিজের প্রতি বিশ্বাস, দুই. অপরের প্রতি মনোভাব, তিন. সদাচরণ বা সদ্ব্যবহার। কর্মক্ষেত্রে সফলতার লড়াইয়ে প্রয়োজন বুদ্ধি, সততা, সচেতনতা আর সৃজনশীলতার অদম্য শক্তি। আপনার যোগ্যতা সম্পর্কে অন্যরা সচেতন হলে আপনি সঠিক মর্যাদা পাবেন। পেশাগত জীবনে সফলতার জন্য লড়াই করাটা নতুন কিছু নয়। নিজের সম্পর্কে বিশ্বাস বলতে কিছু কিছু বিষয়কে বোঝায় যেমনÑ ক. বুদ্ধিমত্তা, খ. কাজে মনোযোগী, গ. করিৎকর্মা, ঘ. সৃজনশীল, ঙ. দক্ষতা, চ. সততা, ছ. পরিপাটি জীবন। নিজের যোগ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর অন্যতম উপায় হলো দায়িত্বশীল ভূমিকা। এটি প্রমাণ করতে পারলে অপরাপরে জন্যও সুবিধাজনক। আবার মনোভাব হলো নিজস্বতা যেমনÑ ক. যা করছি ঠিকই করছি, খ. আমার কাজ সব সময় ঠিক নাও হতে পারে। নিজের সম্পর্কে আপনার এসব ধারণাই সবার থেকে আপনাকে আলাদা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা আর বিচক্ষণতাই নিশ্চিত করবে অপরের সঙ্গে আপনি কীভাবে ভাব আদান-প্রদান করবেন। একবার নিজের সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি হয়ে গেলে আচার ব্যবহারের ধরনও সে অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে যায় অথবা করে নিতে হয়। তখন তার থেকে সরে আসতে চাইলেও নিজের ভেতর থেকে আপনি বাধাপ্রাপ্ত হবেন। ব্যবহার বলতে বোঝায়Ñ ক. নিজেকে কমিয়ে বলা কিংবা অতিরঞ্জিত করে নিজেকে প্রকাশ করা। খ. অপরকে বুঝতে পারা অথবা ভুল বোঝা। মনে রাখবেন, নিজের মাঝে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া বা এই প্রতিরোধই আপনার ব্যবহারে এনে দেবে শৈল্পিক পরিবর্তন এবং মার্জিত স্থিতিশীলতা। যার ফলে আপনি নিজেকে একবার যোগ্য বলে ভেবে নিলে পর মুহূর্তে আর আপনি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে নিজেকে কিছুতেই অপদার্থ বলে ভাবতে পারবেন না। এভাবে একবার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে ভবিষ্যতে নিজের প্রভাব খাটানোর সময় আপনাকে কোনো রকম কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে না।

লেখক : আত্মোন্নয়ন গ্রন্থ রচয়িতা ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close