নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৮ জুলাই, ২০১৯

মুক্তমত

শিশু ধর্ষণ ও হত্যার শাস্তি হোক মৃত্যুদন্ড

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুর অন্তরে। এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত ও বঞ্চিত শিশুদের জন্য ঘুণেধরা এ সমাজ ভেঙে এক নতুন পৃথিবী গড়ার সুকঠিন অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি জানতেন, পুরাতন এই পৃথিবী আগামী দিনের সুকোমল, মেধাবী শিশুদের জন্য বাসযোগ্য হবে না। শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ ও বেড়ে ওঠার জন্য আধুনিক চিন্তা ও চেতনায় উদ্ভাসিত এক নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও নির্মম হত্যার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে মনে হয়Ñ সুকান্ত আজও প্রাসঙ্গিক।

সম্প্রতি ঢাকার ওয়ারীতে ৭ বছরের নিষ্পাপ শিশু সামিয়া আফরিন সায়মাকে যেভাবে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, তাতে সারা দেশের অবোধ শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মনে এ ধরনের আশঙ্কা ও ভীতির সঞ্চার হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই পাশবিক হত্যাকান্ডের ভয়াবহতায় সারা দেশের বিবেকবান মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে দেশের বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুরা মানববন্ধন করছে। রাস্তায় নেমে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে।

‘আমি পারি নাই আমার মেয়েকে রক্ষা করতে। দেশবাসীর কাছে আমার আবেদন, আপনাদের যাদের মেয়ে রয়েছে, তাদের এমন পশুসুলভ আচরণ থেকে কীভাবে দূরে রাখা যায়, তা একটু ভেবে দেখবেন’Ñ এমন মর্মস্পর্শী আবেদন করেছেন পাশবিক নির্যাতন ও হত্যার শিকার শিশু সায়মার পিতা আবদুস সালাম। রাজধানীর ওয়ারীর সিলভারডেল স্কুলের নিহত শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন সায়মার সন্দেহভাজন হত্যাকারী হারুন অর রশিদ গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে গত ৭ জুলাই তিনি এসব কথা বলেন। নিহত সায়মার বাবা অতি দ্রুত সময়ে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে মূল আসামির সর্বোচ্চ শান্তি চান। তার মেয়েকে দুই রকম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।

ধর্ষক হারুন অর রশিদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, রাজধানী ওয়ারীতে ৭ বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সায়মাকে ধর্ষণ করে হত্যার আগে ছাদ দেখানোর কথা বলে ডেকে নেয় ধর্ষক হারুন। এরপর ভবনের ৯ তলার ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে শিশুকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর শিশুটির ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়। শিশুটিকে নৃশংসভাবে হত্যার পর গলায় রশি পেঁচিয়ে টেনেহিঁচড়ে ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে নিয়ে সিঙ্কের নিচে রেখে পালিয়ে যায় ঘাতক। শিশুটি যে বাড়িতে থাকত, সেই বাড়িতেই হারুন তার খালাতো ভাই পারভেজের সঙ্গে থাকত। কাজ করত পারভেজের রঙের দোকানে।

শুধু ওয়ারীতে নয়, ভালুকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানী মুগদা হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির আর এক শিক্ষর্থীকে যমুনা এক্সপ্রেস নামক চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণ করা হয় উখিয়ায় মসজিদের ভেতর এক শিশুকে। আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি কোনো কিছুই থামাতে পারছে না এই জঘন্য অপরাধ থেকে বিকৃতমনা মানুষ নামের পশুদের। শিশু ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুর ও অমানবিক কাজে কে যুক্ত নেই? ১৮ বছরের বখাটে যুবক, ৬০ বছরের বৃদ্ধ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মাদরাসার অধ্যক্ষ, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিতÑ সবাই অবলীলাক্রমে জড়িয়ে পড়ছে এই অপকর্মে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ৩৯৯ শিশু। ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ৪০৮টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এ তথ্য তুলে ধরে। অপরদিকে একই সময়ে সারা দেশে ৪৯৬টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করে বাংলাদেশের শিশু অধিকার ফোরাম। ১৫টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সম্প্রতি ‘শিশু অধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক এ উপাত্ত প্রকাশ করে সংস্থাটি। অব্যাহত শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একজন শিশু অধিকার আইনজীবী বলেন, শিশুরা ফুলের মতো পবিত্র। তাদের সুরক্ষার মধ্য দিয়ে লালন-পালন করতে হয়। অথচ বাবা-মা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে তিনি আরো বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। দেশের একজন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানীর কথাÑ নৈতিকতাও মূল্যরোধের অবক্ষয়, বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ না থাকায় দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এটা এখন বিকৃতির পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রবাহকে শিশু নির্যাতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক। তার মতে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ ভোগবাদী। কিন্তু দেশে নৈতিকতার অধঃপতনের পাশাপাশি আইনেরও কোনো প্রয়োগ নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্ষণ রোধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্রিন ইউনিভার্সিটির একজন সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের শিক্ষকের ভাষ্যমতে, গত এক বছরের চিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, নির্বাচনের সময়টাতেই শিশু ধর্ষণ তুলনামূলক কম ছিল। এ থেকে অনুমান করা যায়, রাজনৈতিক কর্মীরা ব্যস্ত থাকায় তখন এ ধরনের অপরাধ কম সংগঠিত হয়।

বিগত দুই দশকে দেশের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক ভিত্তিতে পরিবর্তন হয়েছে। এমন বাস্তবতায় শুধু আইন করে ধর্ষণের মতো অপরাধ দূর করা যাবে না। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে নৈতিকতার ও মূল্যবোধ চর্চা আরো জোরদার করা জরুরি। আগে শিশুরা শুধু ধর্ষণের শিকার হতো। এখন ধর্ষণের পর শিশুকে মেরে ফেলা হচ্ছে। এটা হিংস্রতা ও বর্বরতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিশুদের রক্ষায় প্রচলিত আইনে সংশোধন আনতে হবে। যে ধরনের শিশু নির্যাতন হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে রায় কার্যকরের সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। তা হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি ও শিশুদের ওপর পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে আবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করে একাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রয়োজনে বিদ্যমান আইনকে আরো কঠোর করা হবে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর কেউ সাহস না পায়।’

পৃথিবীর অনেক দেশে ধর্ষকদের শাস্তি হিসেবে অল্প সময়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ হ্রাস পাচ্ছে। চীনে ধর্ষণ প্রমাণ হলেই কোনো সাজা নয়, বিশেষ অঙ্গ কর্তন এবং সরাসরি মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। ইরানে ধর্ষককে ফাঁসি, না হয় সোজাসুজি গুলি করে হত্যা করা হয়। আফগানিস্তানে ধর্ষণ করে ধরা পড়লে চার দিনের মধ্যে ধর্ষককে মাথায় সোজাসুজি গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকরা করা হয়। উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে গুলি করে হত্যা করা হয়। সৌদি আরবে জুমার নামাজের পর ধর্ষককে প্রকাশ্যেই শিরñেদ করা হয়। মিসরে ধর্ষককে জনসম্মুখে ফাঁসি দেওয়া হয়। শিশু ধর্ষণ ও শিশু হত্যার মতো এ পাশবিক অপরাধ দমনে বাংলাদেশেও স্বল্প সময়ের মধ্যে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close