ইয়াসমীন রীমা

  ১১ জুলাই, ২০১৯

নারী

আনুগত্যে অন্ধ বিদ্যাবুদ্ধিতে দিব্য

স্বাধীনতার অর্থ স্ব-অধীন। নিজেই নিজের অধীন। এর ফলে নিজেকে সব সময় কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। কেননা, আমার স্বাধীনতা গ্রাহ্য হতে পারে তখনই; যখন আমি অন্যের স্বাধীনতাকে স্বীকার করবÑ সেটা বাক স্বাধীনতাই হোক কিংবা বেঁচে থাকার অধিকার। তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার, কোনো স্বাধীনতাই পুরোপুরি স্বাধীনতার কথা বলে না। পুরোপুরি স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার সমান, পুরোপুরি স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। দীর্ঘদিন আগে হেফাজতিরা মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাদের ১৩ দফা প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানায়। সেখানে নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং নারীর অধিক শিক্ষাদান থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়। নারীদের নিয়ে এ গণতান্ত্রিক দেশে যে প্রবল অতিঘাত সৃষ্টি করা হলো, তা স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা।

হিংস্র্র ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা মানুষের কতটুকু? হিংসার ভাষা তো শুধু শারীরিক আক্রমণের প্ররোচনা নয়, তা এক সুদূরপ্রসারী অশনিসংকেত। অহোরাত্র চারপাশে এক ব্যক্তির প্রতি আর এক ব্যক্তির, এক দলের প্রতি আর এক দলের, এক গোষ্ঠীর প্রতি আর এক গোষ্ঠীর, এক দেশের প্রতি আর এক দেশের ভাষায় হিংসা পরিব্যাপ্ত হয়। গণতন্ত্রে বাক স্বাধীনতা একটি মূল্যবান স্বীকৃতি আর বাক স্বাধীনতা পালনেও আমাদের দায়িত্ব অসীম। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তুলছেন না, এই বাক স্বাধীনতায় হিংসার ভাষা কিংবা ভাষায় হিংসা ব্যবহারের স্বাধীনতা আমাদের কতটুকু?

লক্ষণ-সীতার ভিটার চারদিকে একটি রেখা টেনে দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত যেকোনো লোক আসুক সীতা যেন রেখার বাইরে পা না দেয়। তা হলেই সীতার কোনো রূপ অঘটন ঘটবে না। বাংলা প্রবচনে যার নাম ‘লক্ষণ রেখা’ পুরাণের সময় পার করে আমরা ফেসবুক ডটকমের জগতে প্রবেশ করেছি, কিন্তু নারীর জন্য থেকে গেছে সেই অদৃশ্য তথাকথিত লক্ষণ রেখা। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনায় লক্ষণ রেখাটিকে আর অদৃশ্যমান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, বরং মনে হয়েছে ওই লক্ষণ রেখাটিই তার সাংস্কৃতিক বাধ্যবাধকতা। দুই বছর আগে ফেলোশিপের কাজে আমার আমেরিকায় লস অ্যাঞ্জেলসে থাকা হয়েছিল, সেসময় আমার এক প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি ছিলেন বয়োবৃদ্ধ। নাম তার মরিস গিলাবার্ড। যৌবনকালে মিসরীয় সরকার তাকে এক বছরের জন্য নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় কায়রোতে। কায়রোতে অবস্থানকালে কয়েক মাস অতিবাহিত থাকার পর তার স্ত্রী রুডিও মাহা কায়রোতে যান। প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিসর। ফেরাউনেরদের দেশ এখানে-সেখানে সর্বত্র পিরামিড ছড়িয়ে রয়েছে। মিসর যতটুকু দেখা যায় দেখার অভিপ্রায়ে আরো দুই দিন ছুটি বাড়িয়ে আরেক শহরে যাবেন বলে মন স্থির করলেন মরিস গিলাবার্ড তার স্ত্রী রুডিও মাহা ও শিশুপুত্র প্লাডিও। প্লেনের টিকিট কিনতে গেলেন তিনজনই। টিকিট বিক্রেতার কাছে মরিস গিলাবার্ড তাকে ও তার স্ত্রীকে দেখিয়ে দুটি টিকিট এবং শিশুপুত্রকে দেখিয়ে হাফ টিকিট দিতে বললেন। টিকিটবিক্রেতা বারবার তাদের দিকে তাকিয়ে একসময় বললেন, তোমাদের দেড়খানা টিকিট হলে চলবে। মরিস তখন আবাক হয়ে জানতে চাইল ব্যাপার কী? টিকিট বিক্রেতা বললেন, মালপত্রের জন্য যেমন টাকা নেওয়া হয় না, মেয়েছেলের জন্যও ভাড়ার প্রয়োজন হয় না। মরিস তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছেন। ভাবলেন কী অবমাননাকর, ঐঁসরষরধঃরহম ধারণার ওপর অবস্থান করছে ব্যবস্থাটি। মরিসের কাছে এ অভিজ্ঞতার কথাটি কয়েকবারই শুনেছি আর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, তোমাদের দেশেও কি মালপত্র ও মেয়েছেলে একই পর্যায়ে গণ্য করা হয়?

হেফাজতের ১৩ দফার ৪নং দফায় ‘নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ’ বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশের পুরুষদের পাশাপাশি সাজ উন্নয়নে অবদান রাখছে ব্যাপক। হেফাজতের ইসলামের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই এ বিষয়টি উপলন্ধি করবেন। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলায় ধর্ষিতা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ১৯ দিন অবহিত হওয়ার পরও থানায় যেতে পারে না। একই গ্রামের আবু বক্করের ২২ বছরের ছেলে রিপন মিয়া ষষ্ঠ শ্রেণির শিশুকে গত ১৫ জানুয়ারি গলায় চাকু ধরে ধর্ষণ করে। মেয়েটির মা ছুটে যায় গ্রাম পঞ্চায়েতের দিকে। সালিস করতে চায় চুপিসারে। কারণ ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়লে তার মেয়েরই আরো ক্ষতি। বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে যাবে ক্ষীণ। ইউপি সদস্য এবং ইউপি চেয়ারম্যানও ব্যর্থ হয় ধর্ষণকারীকে সালিসে উপস্থিত রাখতে। ষষ্ঠ শ্রেণির শিশু মেয়েটি এখন তাই শুধু চোখের পানি ঝরায় আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন মায়ের চোখ এড়িয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ২২ বছরের বিউটি খাতুন ধর্ষণের শিকার হয় তারই প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গীদের দ্বারা। ধর্ষণের ভিডিওচিত্রটি ধর্ষকরা এবং তার প্রাক্তন স্বামী লোকসমাজে প্রকাশ করে দিলে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হতভাগ্য বিউটি আত্মহত্যা করে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ধর্ষণ ও শিশুদের হত্যা এবং নির্যাতনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। চলতি বছরে প্রথম ছয় মাসে দেশে ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জন নারীকে। অধিকন্তু ছয় মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২৭ নারী। গত ছয় মাসে ৮৯৫ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনে ও হত্যার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ১০৪ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ৪০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে, নিখোঁজের পর এক শিশু এবং বিভিন্ন সময়ে ১৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ৪১ শিশুর। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে মোট ১১ জন নারী। ধর্ষণকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। পত্রপত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনাটি এসবের মধ্যে সীমিত থাকছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে।

নারী হওয়ার মতো নিকৃষ্ট কিছু আর না। জুডিথ ওয়ালশ সম্পাদিত ‘হাউ টু বি দ্য গডেস অব ইয়োর হোম’ বইটি পড়লে এ কথাটি ধারণায় এসে যায়। উনিশ শতকের শেষ দিকে নারীদের জন্য ‘ম্যানুয়াল’ বা নির্দেশিকা লেখার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর উপদেশ, গৃহলক্ষ্মী, কুমারী শিক্ষা, এমনই নাম থাকত এসব বইয়ের ভেতর। ১৮৮০-১৯০০ সালের মধ্যে বাংলায় অনন্ত গোটা চল্লিশ এমন বই প্রকাশিত হয়েছিল। নারীরা কী পরবেন, কী বাঁধবেন, কেমন করে ছেলে মানুষ করবেন, ঘর পরিষ্কার রাখবেনÑ তার বিস্তারিত উপদেশ লেখা হতো এসব বইয়ে। আজকের নারীরা এসব কথাকে এককথায় ‘জ্ঞান দিচ্ছে’ বল উড়িয়ে দেবেন কিংবা ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ বলে তর্কে জুড়বেন। ১৯১৮ সালে উপন্দ্রে চন্দ্র ভট্রাচার্য লিখেছিলেন ভারতের নারী (যার একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘স্বামী দেবতা’) ২০০২-এ তার ৪৪তম সংস্করণ হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কপি, পুনর্মুদ্রণ হয়েছে গত বইমেলায়ও। জুডিথের কাজটি মূল্যবান, কারণ মূল বইগুলো আর পাঠকের হাতে আসার সম্ভাবনাই নেই। বইটার পৃষ্ঠা ওল্টালে বোঝা যায়, সে যুগের নিরক্ষর অন্তরালবাসিনীরাও বড় সহজে স্বামীদের চাপানো উপদেশ মেনে নিতেন না। গিরিজা প্রসন্ন রায় চৌধুরীর গৃহলক্ষ্মী বইয়ে স্বামী প্রশ্ন করছেনÑ স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি কর্তব্য কী? স্ত্রীর উত্তর, একজন অন্যজনকে ভালোবাসবে। নিজের মনের গোপনতম কথাও অন্যকে বলবে না। স্বামী ক্ষুব্ধ হয়ে থামিয়ে দিলেন স্ত্রীকে। এতক্ষণে এই বুঝলে? ওসব প্রেম-ভালোবাসা হলো মডার্ন ফ্যাশন। শুদ্ধ পুরুষ হাজার রকম হতে পারে, শুদ্ধ নারী মাত্র এক রকম। যে নিজেকে যত বেশি ফতুর করতে পারবেন, সে তত বেশি শুদ্ধ নারী। সবার জন্য সে প্রাণপাত করবে, কিন্তু তার জন্য যাতে কাউকে ঝামেলা সহ্য করতে না হয় তাও তাকে দৃষ্টি রাখতে হবে। দিনভর যে নারী গালমন্দ হজম করছেন, রাতে তাকেই স্বামীর কাছে আসতে হবে হাসিমুখে। কারণ সংসারের আনন্দ বৃদ্ধিই তার কাজ। বিদ্যাবুদ্ধি যুক্তিতে হতে স্বচ্ছ, কিন্তু আনুগত্য অন্ধÑ এই দাবি আজকের লক্ষ্মী নারীদের কাছে সমান জোরালো। তাই আজও মন্দ পুরুষ হতে খানিক কাঠখড় পোড়াতে হয়, মন্দ মেয়ে হতে গেলে আড়চোখে চাইলেই চলে।

বিখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী ‘আমরা ও তোমরা’ প্রবন্ধটা অনেকেই পড়েছেন। প্রবন্ধের শেষে তিনি বলছেন ‘প্রাচী ও প্রতীচী পৃথক। আমরাও ভালো তোমরাও ভালো; শুধু তোমাদের ভালো আমাদের মন্দ ও আমাদের ভালো তোমাদের মন্দ। সুতরাং অতীতের আমরা ও বর্তমানের তোমরা এই দুয়ে মিলে যে ভবিষ্যতের তারা হবে, তাও অসম্ভব। তবে এখন ‘অসম্ভব’ শব্দটি অনেকেই অভিধান থেকে তুলে দিতে চাইছেন। সত্যের সহজ স্বীকারোক্তিতে মানুষ ছোট হয় না বরং তার সংগ্রামের কাহিনি হতাশাগ্রস্ত ও অকৃতকার্য ব্যক্তিদের কাছে সফল হওয়ার প্রধান মূলমন্ত্র।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close