মো. শামীম সিকদার

  ২৯ জুন, ২০১৯

মুক্তমত

উপকূলীয় অঞ্চল উন্নয়নে ইতিবাচক প্রকল্প

উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণে এবং চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প নামে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধীকরণের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যবিমোচন ত্বরান্বিতকরণ। উপকূলীয় চরাঞ্চলের লোকজন বিভিন্ন দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে। এসব দুর্যোগের ফলে উপকূলীয় চরের অধিবাসীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে তাদের জীবনমান পিছিয়ে যায়। সার্বিকভাবে এসব পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি করতেই উপকূলীয় চরাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারের পুষ্টি এবং আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নই এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ছাড়া উপকূলীয় নারীদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা ও লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস করা এবং মুরগি, হাঁস ও ভেড়ার ক্ষুদ্র খামার স্থাপন করে ডিম ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি করার মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের ডিম ও মাংসের চাহিদা পূরণে কাজ করবে এ প্রকল্প।

উপকূলীয় অঞ্চলের নিজস্ব উৎপাদন থেকে পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় ঘাটতি থাকে। ফলে এখানকার মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। বিশেষ করে চরের অধিবাসীদের অপুষ্টির মাত্রা বেশি থাকে। তারা আর্থিকভাবে দুর্বল থাকায় এ অভাব কোনোভাবেই পূরণ করতে পারে না। চরের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ অধিদফতর উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের দুটি বিভাগের ৭টি জেলায় ১৬টি উপজেলায় ৬৮টি ইউনিয়নে ৩৪ হাজার ৪০৮টি দরিদ্র পরিবার সরাসরি উপকৃত হবে। ৯৫ কোটি ৩৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প শেষ হবে ২০২১ সালের ৩০ জুন। বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার বেতাগী, পাথরঘাটা, তালতলী ও বরগুনা সদর, পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী এবং ভোলা জেলার চরফ্যাশন, দৌলতখান ও লালমোহন উপজেলা। চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, নোয়াখালী জেলার কবিরহাট, ফেনী জেলার সোনাগাজী এবং লক্ষ্মীপুর জেলার লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর ও রামগতী উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পভুক্ত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সুফলভোগী বাছাই করা হবে। ইতোমধ্যে সুফলভোগী বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রকল্পের উপকরণ বিতরণ এবং মনিটরিংয়ের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির উপস্থিতিতে সুফলভোগীদের মাঝে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হবে। ইউনিয়নে নিয়োগকৃত লাইভস্টক ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর, সুফলভোগীদের প্রদেয় উপকরণসমূহের সুষ্ঠূ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করবেন। এ ছাড়া এ কমিটি সুফলভোগীরা যেন উপকরণসমূহের কোনো ধরনের অপব্যবহার করতে না পারে; সে বিষয়ে মনিটরিং করবে।

এ প্রকল্পের আওতায় ভেড়া, মুরগি, হাঁস, কবুতর ও ঘাসের প্রদর্শনী প্লটÑ এই ৫ প্যাকেজের আওতায় ২৫ জন সুফলভোগী নিয়ে লাইভস্টক ফার্মার গ্রুপ গঠন করা হবে। প্রতি ইউনিয়নে সর্বোচ্চ ২০টি গ্রুপে ৫০০ জন সুফলভোগী প্রকল্পভুক্ত হবে। ইউনিয়নের প্রকল্পভুক্ত সুফলভোগীর মধ্যে ১০০ জনকে দেওয়া হবে ৩টি করে ভেড়া, ২৫০ জনকে ২০টি করে খাঁকি ক্যাম্বেল হাঁস এবং ১৫০ জনকে ২০টি করে সোনালি মুরগি দেওয়া হবে। এ ছাড়া কবুতর পালনকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতি ইউনিয়নে একজনকে কবুতর এবং পাঁচজনকে উন্নত মানের ঘাস উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ করা হবে। প্রতি সুফলভোগীর এসব প্রাণী রাখার জন্য একটি করে সেড সরবরাহ করা হবে। সুফলভোগীদের উন্নত প্রযুক্তি, সঠিক খামার ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা এবং বাসস্থান সম্পর্কিত সব ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। সুফলভোগী প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ভেড়া পালনকারীদের ৫০ ভাগ এবং হাঁস ও মুরগি পালনকারীদের মধ্যে শতভাগ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। এসব প্রাণী পালন টেকসই করার জন্য বর্ষাকালে মুরগি ও ভেড়া এবং শুকনো মৌসুমে হাঁসের জন্য ৪ মাস খাবার ও প্রয়োজনীয় মেডিসিন এবং ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে। উৎপাদিত ঘাস বিক্রির জন্য প্রতি উপজেলায় একটি করে ঘাসের বাজারের অবকাঠমো নির্মাণ করা হবে। এ বাজার স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার প্রকল্প বহন করবে। সুফলভোগীদের এনিম্যাল হেলথ কার্ড প্রদান করা হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ের কার্যক্রম দেখভাল করার জন্য প্রতি ইউনিয়নে একজন করে লাইভস্টক ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার লাইভস্টক ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর ও লাইভস্টক ফার্মার গ্রুপ সদস্যদের সমন্বয়ে উঠান বৈঠক করা হবে। বৈঠকে আলোচিত সমস্যাবলি লাইভস্টক ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর সমাধানের উদ্যোগ নেবেন।

চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা আবর্তিত হয় নদী ঘিরেই। চরের মানুষের সুখ-দুঃখের শেষ নেই। কেননা চরের জীবন মূল ভূখন্ড থেকে অনেকটাই আলাদা। স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা, জীবন-জীবিকা, অন্যান্য সেবা ও সুযোগ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন চরের লাখো মানুষ। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় চরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুবই করুণ। চরে কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস সীমাবদ্ধ। এমনও অনেক চর আছে সেখানে বংশানুক্রমে অনেক পরিবার শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শুষ্ক মৌসুমে সুখের মুখ দেখলেও বর্ষায় ভাসমান জীবনযাপনে কষ্টের শেষ নেই তাদের। খরা-শুষ্ক মৌসুমে বিশাল বিশাল চর জেগে উঠলে সেখানে আবাদ হয় মরিচ, ধান, শাকসবজি ও মৌসুমি ফসল। চরের জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকার জন্য কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশু ও পাখি লালন-পালনের ওপর নির্ভশীল। হাঁস, মুরগি ও ভেড়া চরাঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে সহজে অভিযোজিত হতে সক্ষম। প্রচুর পরিমাণ চারণভূমি থাকায় চরে গড়ে ওঠে গরুÑছাগল পালনের খামার। চরের অধিবাসীর অধিকাংশই বেকার থাকায় অর্থনৈতিকভাবে তারা দুর্বল থাকে। এসব বিবেচনায় সরকার সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রার ২৩২টি সূচকের মধ্যে উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে ৫টি অভীষ্ট সরাসরি যুক্ত রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এসডিজির যেসব অভীষ্ট অর্জন হবে, তার মধ্যে রয়েছে সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান হবে (অভীষ্ট-১), ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার হবে (অভীষ্ট-২), জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন ঘটবে (অভীষ্ট-৫), সবার জন্য পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্ম সুযোগ সৃষ্টি এবং স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে (অভীষ্ট-৮) এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে (অভীষ্ট-১৩)। এ প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এসডিজির উপরোক্ত অভীষ্ট বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

প্রকল্প শেষে কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য সুফলভোগীদের নিয়ে লাইভস্টক কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন গঠন করে এর সদস্যরা উপকরণের নির্ধারিত মূল্য সঞ্চয় করবে। পরবর্তীতে জমাকৃত এ অর্থ আয়বর্ধক কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে প্রকল্পের সুফলভোগী পরিবারগুলো লাইভস্টক কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। এই কমিটিকে সমবায় সমিতি আকারে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হবে।

উপকূলীয় চরাঞ্চলের প্রাণিসম্পাদ নিয়ে এ ধরনের প্রকল্প এই প্রথম গ্রহণ করা হলো এবং এটা পাইলট প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে হয়তো পরবর্তীতে সারা দেশে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং সততার সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। বর্তমানে আলোচিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশ তোলার মতো যেন না হয়। আশা করি, এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা কৃচ্ছ্র ও সততার সঙ্গে কার্যসম্পাদন করবেন। নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রীকে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। সুফলভোগীরা যেন প্রকল্প শেষে কার্যক্রম চলমান রাখতে প্রকল্পের পক্ষ থেকে লাইভস্টক কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশনকে সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধন করে দিলে সংগঠনের লক্ষ্যে পৌঁছা সহজ হবে। উপকূলীয় এলাকায় চরের লোকজনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং পুষ্টি ও প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি মোকাবিলায় উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close