নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৬ মার্চ, ২০১৯

বিশ্লেষণ

সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়

এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে ফল, নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল। ৮ মার্চ, সারা বিশ্বে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের নারী দিবসের ষ।গান হচ্ছে- ‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো, নারী-পুরুষ সমতা, নতুন বিশ্ব গড়ো।’ পৃথিবীতে সব অর্জনের পেছনে রয়েছে ত্যাগের মহান ইতিহাস। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়।

কার্ল মার্কসের মতে, পৃথিবীর সন্তান হলেও মানুষ প্রকৃতির দাস নয়। মানুষ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার পারিপার্শি¦ক অবস্থাকে ভেঙেচুরে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলে। এই সংগ্রাম ও সংগ্রহের কাজে যুগে যুগে নতুন প্রযুক্তি বিজ্ঞান আর কলাকৌশল উদ্ভাবন করতে হয় মানুষকে। ঐতিহাসিক কাল থেকে কখনো পাথরের হাতিয়ার, কখনো লৌহ ও কাঠের জিনিস, কখনো লাঙ্গল, তাঁতযন্ত্র আবার কখনো বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করতে হয়েছে মানুষকে। যেহেতু মানুষ সমাজ থেকে নিষ্ক্রিয় বা বিমূর্ত কোনো জীব নয়, সেহেতু বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হয়। নারীকেও তার বর্তমান অবস্থায় আসতে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। হতে হয়েছে নির্মম নির্যাতনের শিকার।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমে আসেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলেও চলে সরকারি পেটুয়া বহিনীর নিপীড়ন। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ ও জার্মান কমুনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। তারপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। ওই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হয়। দিবসটি পালনে বিশেষ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই দিবসটি পালিত হচ্ছে নারীর সম-অধিকার আদায়ের প্রত্যয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে।

নারীদের জন্য বিনিয়োগ করা উচিত, যা যেকোনো দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সবচেয়ে কার্যকর কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের মতো কতগুলো দেশ কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করছে। দেশটি যদি এ ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে আগামী দশকে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৩৪ থেকে ৮২ শতাংশে উন্নীত হবে, যা বাংলাদেশের জিডিপিতে ১ দশমিক ৮ শতাংশ যোগ করবে। পেরুর রাজধানী লিমায় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে আজ থেকে চার বছর আগে এসব কথা বলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিং।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে যে খাতগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তাদের নিরলস পরিশ্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষি উৎপাদন। দেশ হয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে দেশের ৭০ শতাংশের বেশি ভূমিহীন নারী কৃষিকাজে জড়িত। জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রামীণ নারীরা ঘর ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন কৃষিকাজে। মজুরির ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম তাঁরা। গত এক দশকের ব্যবধানে কৃষিকাজে প্রত্যক্ষভাবে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০০১ সালের জরিপ অনুযায়ী, কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১০ সালের জরিপ অনুয়ায়ী তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১০ সালে কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন ২ কোটি ৫৬ লাখ শ্রমিক এর মধ্যে নারী প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ। এ দশক আগেও তা ছিল মাত্র ৩৮ লাখ। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ নারী। আবার গত এক দশকে কৃষিকাজে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ যে হারে বেড়েছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামী এক দশকের মধ্যে তুরা পুরুষকে ছাড়িয়ে যাবে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায়, বর্তমানে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ১৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর গ্রামীণ নারীর ৭১ শতাংশ এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত। চা-শিল্প বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় কৃষি খাত। এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। কর্মরত শ্রমিকের অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ৮৫ টাকা। এই মজুরি দিয়ে একজন শ্রমিকের পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এ ছাড়া তাদের বাসস্থান ও চিকিৎসা এবং সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধাও সীমিত। চা শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে মালিকপক্ষ ও সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

২০১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করে। মোট রতানি আয়ে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮০ শতাংশ। এ দেশে রয়েছে ৭ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানা। পোশাক কারখানাগুলোতে ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত, যার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই হলো শ্রমিক। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ডে-কেয়ার সেন্টারসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ মতে, প্রবাসে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ শ্রমিকের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮৬ হাজার। এসব নারী শ্রমিক সৌদি আবরসহ মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও ঘরে-বাইরে নারী আজও নির্যাতনের শিকার থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। নারীর প্রতি বৈষম্য, অপহরণ, খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো বাংলাদেশে ঘটছে অহরহ। পরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারী এখনো শিকার হচ্ছে যৌন নির্যাতনের। এ ছাড়া যৌতুক ও বাল্যবিবাহের অভিশাপ তো রয়েছেই। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ ভাগ নারী। তাদেরকে গৃহের চার দেয়ালের ভেতর বন্দি রেখে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তাই নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, যৌতুক ও বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে সব মানুষের অংশগ্রহণে স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সম্প্রতি আইএমএফের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গসমতার উপকারিতা ধারণাতীত। নারীরা কর্মক্ষেত্রে নতুন নৈপুণ্য নিয়ে আসে। তারা কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর আকার বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। এসব সুবিধা সত্ত্বেও বিশ্ব অত্যন্ত ধীরগতিতে লিঙ্গসমতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে । বিশ্বে মাত্র ছয়টি দেশ নারী ও পুরুষকে কর্মক্ষেত্রে আইনগতভাবে সম-অধিকার দিয়েছে। দেশগুলো হলো ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ ও সুইডেন। বিশ্বব্যাংকের ‘ উইমেন বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮৭টি দেশে নারী লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত এক দশকে লিঙ্গসমতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে ফ্রান্সে। দেশটিতে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে আইন ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তির বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টালিনা জার্জিয়েভার মতে, লিঙ্গসমতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। আরো সমৃদ্ধশালী বিশ্ব গড়ে তোলায় তাদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারীরা পুরুষের মতো উপার্জনশীল হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি প্রায় ১ ৬০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমৃদ্ধি অর্জিত হবে। এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, নারীদের সুযোগ দেওয়া হলে বিশ্বজুড়ে আরো সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি., নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close