মোতাহার হোসেন

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

মতামত

প্রয়োজন নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা

মৃত্যু নিয়ে যুগে যুগে লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকরা অনেক শিল্পকর্ম তথা গল্প কবিতা, উপন্যাস রচনা করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর নিজস্ব কোনো রূপ, রস, গন্ধ নেই। মৃত্যুর মধ্যদিয়ে জীবনের অবসান হলেও থেকে যায় অনেক স্মৃতি ও কর্ম। তবে রবীনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান’ অর্থ্যৎ তিনি মরণকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কোনো কোনো মৃত্যু একটি পরিবার নয়, গোটা সমাজকে, দেশকে কাঁদায়। তেমনি সম্প্রতি রাজধানীর নাম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় শুধু ছাত্রসমাজ নয়, পুরো দেশবাসীকে কাঁদিয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা আমাদের সস্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাই শিক্ষা অর্জনের জন্য, লাশ হওয়ার জন্য নয়। কিন্তু হচ্ছে তাই।

দেশে শিক্ষকের অবমাননাকর, আপত্তিকর, দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকান্ডের কারণে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা এই প্রথম নয়। এই ভিকারুননেসায় এর আগেও একাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। শুধু একটি বিভাগ বা বিষয় পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে নবম শ্রেণির এক মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। চাঁদপুরের এক স্কুলের শিক্ষার্থীকে পড়া না শিখায় কয়েকজন ছাত্রীকে প্রখর রোদে প্রকাশ্য খেলার মাঠে সূর্যমূখী করে কপালে ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখায় তাদের মধ্যে একজন অপমানে বাড়ি গিয়ে আত্মহত্যা করে। এরকম খবর প্রায়শই আমাদের দৃষ্টিতে আসে। আবার পরীক্ষায় ফেল করেও কেউ কেউ আত্মহত্যা করে। অথচ আজ থেকে একযুগ বা তারও আগে এমনটি লক্ষ করা যায়নি। আগে না ঘটনার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলেছেন, এখনকার অনেক শিক্ষক মানবিকতা ও নৈতিকতা বিবর্জিত পুরোপুরি আর্টিফিশিয়াল। অর্থলোভে তাদের কা-জ্ঞান লোপ পেয়েছে। আগের শিক্ষকরা ছিলেন নৈতিক ও মানবিক গুণসম্পন্ন। ছাত্রদের তারা সন্তানতুল্য মনে করতেন। এখন শিক্ষকরা ছুটছেন অর্থের পেছনে, অনেকটা রোবর্টের মতো।

সম্ভবত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, শাখাপ্রধান জিন্নাত আরা এবং অরিত্রির শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনার আগেরকার দিনের শিক্ষকের মতো ও রকম কোনো শিক্ষক ছিলেন না। এটা বলাবাহুল্য, যদি মানবিক এবং নৈতিক গুণে গুনানিত্ব হতেন তাহলে তারা একজন ছাত্রী ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে এরকম অশোভন আচরণ করতেন না এবং প্রদর্শন করতেন না ভয়ভীতিও। একজন শিক্ষকের শিক্ষা দেওয়ার পারদর্শিতার চেয়ে প্রথম প্রয়োজন তার শোভন আচরণ। আমরা জানি, এ পি জে আবুল কালাম শুধু ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, কেবল বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষক এবং একজন উজ্জ্বল মনীষী। তিনি বলেছিলেন, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, যা কোনো শিক্ষার্থীর চরিত্র, যোগ্যতা ও ভবিষ্যৎকে একটি বিশেষ রূপ দেয়। যদি মানুষ আমাকে একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে স্মরণ করে, তাহলে ওটা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মানের। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং গুনী ব্যক্তি কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান তার এক নিবন্ধে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ছাত্র আর পুত্র অন্যায় করলেও তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হয়। তাদের কোনো কিছুতে না করা যায় না।’ কিন্তু ভিকারুননিসা সহ এ যুগের শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই মনোভাব লক্ষ্যণীয় নয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করছেন অধ্যক্ষ, পাশে দাঁড়িয়ে অরিত্রি তা দেখেছে। তারপর বাবা-মাকে স্কুলে রেখেই তার প্রস্থান। বাসায় ফ্যানের সঙ্গে তার শেষ নিঃশ্বাস। এই সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে গেল অরিত্রীর মতো একটি ফুটন্ত গোলাপের।

নিরন্তর জীবনে আমাদের মৃত্যু আসে একেক চেহারায়, একেক গন্ধে। মানবিক লেখক এরিক মারিয়া রেমার্ক তার ‘এ টাইম টু লাভ অ্যান্ড এ টাইস টু ডাই’ বইয়ে লিখেছেন- ‘মৃত্যু; ছোট্ট একটি শব্দ, অথচ কী অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। এক নিমেষে থমকে দাঁড়ায় জীবন, হোক সে তুচ্ছ কিংবা অপার সম্ভাবনাময়। একমুহূর্ত আগেও যে ছিল উচ্ছল প্রাণবন্ত, পরমুহূর্তেই সে নেই। কি আশ্চর্য, কি অবিশ্বাস্য একজন মানুষের থাকা, না থাকা। ঠিক এমনটি বিশ্বাস করেননি ডা. কাজী মো. মহসিন ফারুকও। চট্টগ্রাম থেকে এই চিকিৎসক রাত পেরিয়ে বাসে আসছিলেন ঢাকায়। কয় মাস আগে আকদ হওয়া চক্ষুচিকিৎসক স্ত্রী রুম্পাও ঢাকায় পৌঁছবেন সিলেট থেকে। একটি হাসপাতালে পরীক্ষা দেবেন তিনি। জানুয়ারিতে জাঁকজমক আয়োজনে বিয়ে হবে তাদের। কিন্তু রুম্পার সকালটাই পেরোল না। সিএনজিতে চড়া তাকে ধাক্কা দেয় একটা বাস। মারা যান তিনি। ছয় বছরের সম্পর্ক শেষে পরিণত জীবন আর যাপন করা হলো না তার। নিথর দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। বাবা আখতারুজ্জামান চোখে প্রবল জল নিয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘তোমরা আমার মেয়েটাকে কাটতে দিয়ো না।’

জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি বলেছেন, মৃত্যু জীবনের বিপরীত কিছু নয়, বরং ওটা জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর ফার্সির কবি আল্লামা রুমি বলেছেন, মৃত্যু বা ‘বিদায় হচ্ছে তাদের জন্য, যারা তাদের চোখ দিয়ে ভালোবাসে। যারা হৃদয় এবং আত্মা দিয়ে ভালোবাসে, তাদের জন্য আলাদা হওয়ার মতো কোনো শব্দ নেই।’ আর মৃত্যুকে অমোঘ মেনে ডেনিস লেখক গ্রেন রিংটভেট স্বদর্পে উচ্চারণ করেছেন, ‘জীবনের কী মূল্য থাকত, যদি মৃত্যু না থাকত? যদি বৃষ্টি না থাকত, তবে কে সূর্যটাকে উপভোগ করত? যদি রাত না থাকত, তবে কার এমন অধীর আগ্রহ হতো দিনের প্রতি?’ তাই বলে এভাবে, অকালে, অসময়ে এমন নির্মম মৃত্যু কি কারো কাম্য হয়!

রাজধানীর বাংলা মোটর মোড়ে ঘরের ভেতর কাফনে মোড়ানো আড়াই বছরের ছেলের লাশ আর জীবিত আরেক ছেলেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে আছেন মাদকাসক্ত বাবা নুরুজ্জামান কাজল। দরজায় কেউ উঁকি দিলেই হুমকি তার- সবাই চলে না গেলে হত্যা করব এ ছেলেকেও। গত বছর রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে এক মা তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছে, তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। অথচ এ ধরনের অপমৃত্যূও দেখতে হলো এ সভ্য সমাজকে? উইলিয়াম ওয়ালেস লিংকন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সন্তান। ১২ বছর বয়সে মারা যায় সে। সন্তানের এই অকালমৃত্যুতে লিংকন তার নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীর পক্ষে বড় বেশি ভালো ছিল সে। সৃষ্টিকর্তা তাকে তাই ঘরে ডেকে নিয়েছে। যদিও এটা খুব কষ্টের। ইংল্যান্ডের স্ট্রিট আর্টিস্ট ব্যাংকসি বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যু ঘটে দুবার। প্রথমবার- যখন মানুষ শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরের বার- যখন তার নাম পৃথিবীতে শেষবারের মতো উচ্চারিত হয়। তাই তো মৃত্যুর ক’দিন পরই সম্ভবত, ভিকারুননিসা সেই শিক্ষীকা বা নুরুজ্জামান কাজলের নাম কেউ আর উচ্চারণ করবে না। কিন্তু মৃত্যুর শত বছর পরও আব্রাহাম লিংকনের নাম উচ্চারণ করি আমরা। গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, ‘না আগুন, না বাতাস, না জম্ম না মৃত্যু- কোনো কিছুই আমাদের ভালো কাজকে মুছে ফেলতে পারে না। আমরা সকল ধরনের অপমৃত্যু, অপঘাতে, অসময়ে, অকালে কারো মৃত্যুর পক্ষে নই। সকল জীবনেরই মূল্য আছে। তাই পরিবারে, শিক্ষাঙ্গনে, সমাজে, রাষ্ট্রে অপমৃত্যু রোধে আমরা কঠিন অবস্থানে দাঁড়াই। দৃপ্তকন্ঠে শপথ নেই এসব অব্যবস্থা, অমানবিক ও অনৈতিক কর্মকান্ডে বিরুদ্ধে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close