সাধন সরকার

  ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

মতামত

নিবন্ধনধারীদের প্রতি বৈষম্য

অতি সম্প্রতি ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধনের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। ‘এনটিআরসিএ’ (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এর মাধ্যমে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে গত ৩ ডিসেম্বর ১-১৪ নিবন্ধনের জাতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ১-১৪তম শিক্ষক নিবন্ধনকারীদের জাতীয় মেধাতালিকা অনুসারে নিয়োগ দেওয়া হবে। এর আগে ১-১৩ তম নিবন্ধনধারীদের জাতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল (এখন ১৪তমদের যুক্ত করে ১-১৪ তমদের জাতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হলো)। প্রশ্ন হলো, কেন ১৩ ও ১৪তম নিবন্ধনধারীদের ১-১২তম নিবন্ধনধারীদের সাথে যুক্ত করা হলো। ১৩ ও ১৪তম নিবন্ধন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। ২০১৫ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (স্কুল-কলেজ) শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ম্যানেজিং কমিটির পরিবর্তে ‘এনটিআরসিএ’ কর্তৃপক্ষের হাতে আসার পর প্রিলি, লিখিত ও ভাইভার পরীক্ষা মাধ্যমে ১৩তমদের উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল। তখন কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের এককভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে। তা ছাড়া ১৩ শিক্ষক নিবন্ধনে উপজেলাভিত্তিক স্কুল-কলেজগুলোয় শিক্ষক পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে নিবন্ধনধারীদের পাস করানো হয়েছিল (কেননা তখন উপজেলার স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষক পদ শূন্য না থাকার কারণে প্রিলি পাসের পর লিখিততে অনেক ভালো পরীক্ষা দিয়েও হাজার হাজার শিক্ষক নিবন্ধনপ্রত্যাশী অনুত্তীর্ণ হয়েছিল)। ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের একইভাবে প্রিলি, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাদেরও উপজেলাভিত্তিক শিক্ষক পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে পাস করানো হয়েছিল। সহজ কথায়, ১৩ ও ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধন সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া দুটি নিবন্ধন পরীক্ষা। তাহলে কেন ১-১২তমদের সাথে ১৩ ও ১৪তমদের যুক্ত করা হলো? কেন ১৩ ও ১৪তমদের দু-তিন মাস সময় নষ্ট ও অর্থের অপচয় করে ভাইভা নেওয়া হলো (কেননা ভাইভা নম্বর যোগ হয় না, অথচ ভাইভায় ফেল করানো হয়)? কেন ১৩ ও ১৪তমদের লিখিত পরীক্ষায় উপজেলাভিত্তিক পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে পাস করানো হলো। কেন লিখিত পরীক্ষা অনেক ভালো দিয়েও হাজার হাজার পরীক্ষা ফেল করল? কেন বলা হয়েছিল ১৩ ও ১৪তমদের উপজেলাভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে?

নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১৩ ও ১৪তম নিবন্ধনধারীদের সাথে এমন আচরণ (সরাসরি নিয়োগ না দেওয়া) কোনোভাবেই কাম্য নয়। গত প্রায় ২-৩ বছর ধরে চলা নিবন্ধিত শিক্ষকদের নিয়োগের ব্যাপারে আর কোনো অজুহাত, খামখেয়ালি ও নাজেহালপূর্ণ সিদ্ধান্ত জাতি দেখতে চায় না। সারা দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার হাজার শূন্যপদ থাকলেও কর্তৃপক্ষ থেকে গত প্রায় ৪ বছরে (শুধু ২০১৬ সালে) মাত্র ৬ হাজারের মতো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদ শূন্য থাকার কারণে পাঠদানসহ সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং পড়ছে। যথাসময়ে নিয়োগ না হওয়ায় লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষকরা হতাশায় দিন পার করছেন। ‘এনটিআরসিএ’ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সময়ে সমন্বয়হীন সিদ্ধান্তে শিক্ষক নিবন্ধনকারীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। ‘এনটিআরসিএ’র খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে নিবন্ধনপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন সময়ে মহামান্য হাইকোর্টে অসংখ্য রিট দায়ের করেছে। যেগুলো এখনো চলমান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনধারীরা এককভাবে নিয়োগ পেতে হাইকোর্টে রিট করে। ১৩তমদের যুক্তিতর্ক শুনে মহামান্য হাইকোর্ট ‘এনটিআরসিএ’ কর্তৃপক্ষকে এককভাবে নিয়োগের নির্দেশনা দেয়। তা যদি হয় তাহলে ১৪তমদেরও এককভাবে নিয়োগ পাওয়ার কথা। এরই মধ্যে কেন তাহলে ১-১৪ নিবন্ধনের মেধাতালিকা প্রকাশ করা হলো? প্রশ্ন হলো, ১ম নিবন্ধন আর ১৪তম নিবন্ধন কি একই ধরনের। ১-১২তম শিক্ষক নিবন্ধনে প্রিলির পর লিখিত পরীক্ষায় তখন খুব গুরুত্ব সহকারে বা যেভাবেই খাতাও মূল্যায়ন করা হোক না কেন, তখন অনেকে অনেক বেশি নম্বর পেয়ে গেছেন। ১-১২তম নিবন্ধনের সময় ভাইভাও ছিল না। আর আগের নিবন্ধনগুলোতে বেশিসংখ্যক নিবন্ধনধারী পাস করলেও সাম্প্রতিক নিবন্ধনগুলোতে (১৩ ও ১৪তম) খুব কমসংখ্যক নিবন্ধনধারীদের পাস করানো হয়। আগে ১-১২তমদের মধ্যে যে ৪০ নম্বর পেত, তারও যে মূল্যায়ন, আবার যে ৯০ নম্বর পেত একই মূল্যায়ন করা হতো। কিন্তু এখন ‘এনটিআরসিএ’র হাতে নিয়োগের ক্ষমতা আসার পর পরীক্ষার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। এখন (১৩ ও ১৪তমতে) ভাইভাতে হাজার হাজার পরীক্ষার্থী বাদ পড়ে যায়। যদিও ভাইভা নম্বর যোগ করা হয় না। প্রশ্ন হলো, যে ভাইভার নম্বর যোগ হয় না, কিন্তু পরীক্ষার্থীদের ফেল করানো হয়, মাসের পর মাস ধরে টাকা ও অর্থ নষ্ট করে সে ভাইভা নিয়ে লাভ কী?

সাম্প্রতিক নিবন্ধন পরীক্ষাগুলোর (১৩ ও ১৪তম) গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় লিখিত পরীক্ষার খাতাও খুব নিখুঁতভাবে গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করা হয়। ফলে ১-১২তমদের সাথে সাথে ১৩ ও ১৪ নিবন্ধনধারীদের যুক্ত করা হলে ১৩ ও ১৪ নিবন্ধনধারীদের চারভাগের একভাগও শিক্ষক নিবন্ধনধারীর চাকরি হবে না! কেননা লিখিত পরীক্ষায় তাদের নম্বর কম থাকায় জাতীয় মেধাতালিকায় তারা নিচের দিকে। ১-১২তমদের সাথে ১৩ ও ১৪তমদের যদি যুক্তই করা হবে তাহলে ভাইভা নাটকসহ এত আয়োজন করার দরকার ছিল না। ২০১৫ সালে ‘এনটিআরসিএ’র হাতে ক্ষমতা আসার পর উচিত ছিল ১-১২তমদের জাতীয় মেধাতালিকা করে নিয়োগদানের প্রক্রিয়া শুরু করা। পরে ১৩ ও ১৪তম পরীক্ষার আয়োজন করা (যদিও এ দুটি পরীক্ষা ২০১৫ সালের পর অনুষ্ঠিত হয়েছে)। এখন যথাসময়ে নিয়োগ না পাওয়ায় ১-১২তমরা যেমন ক্ষুব্ধ, তার চেয়ে বেশি হতাশ এককভাবে নিয়োগপ্রত্যাশী ১৩ ও ১৪তম নিবন্ধনধারীরা। লাখ লাখ নিবন্ধনধারীকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করার জন্য ‘এনটিআরসিএ’-ই দায়ী। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না কারণে নিবন্ধনধারীদের মধ্যে এই হতাশা তৈরি হয়েছে। কে নিয়োগের ব্যবস্থা না করে শুধু নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে? এ কথাও সত্য যে, বারবার হাইকোর্টে রিট করার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। আর রিট নয়, আশাকরি সময়োপযোগী ও সুবিচেনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিবন্ধনধারীদের নিয়োগের দরজা খুলে দেবে। তাই ‘এনটিআরসিএ’ কর্তৃপক্ষ থেকে ১৩ ও ১৪তম নিবন্ধনধারীদের প্রতি সুবিচার ও একক নিয়োগের আশা করছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close