মো. মাঈন উদ্দিন

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

সেকাল-একালের কর

বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। আমার আজকের বিষয় ‘ইত্যাদি’ না। এই ইত্যাদি অনুষ্ঠানটি যিনি উপস্থাপনা করেন, তিনি হলেন হানিফ সংকেত। যিনি অধিকাংশ সময় ছন্দ দিয়ে উপস্থাপনা করতে পছন্দ করেন। আমার আজকের বিষয় এই ‘হানিফ সংকেতও’ না। এ মুহূর্তে আমার বিষয় হলো ‘চোর’। হ্যাঁ, ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মধ্যে এক দিন দেখেছিলাম সুইজারল্যান্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন। এ দেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল স্ট্যান্ড আছে। সরকারি খাত থেকে কেনা অনেক সাইকেল এই স্ট্যান্ডগুলোয় জমা থাকে। জনগণের প্রয়োজনে যে কেউ সাইকেলগুলো নিয়ে যেকোনো জায়গায় যেতে পারে এবং সে যেখানে গেল সেখানেও অনুরূপ সাইকেল স্ট্যান্ড আছে, যেখানে সে এই সাইকেলটি জমা রাখে। এভাবে জনগণ তাদের প্রয়োজন মোতাবেক এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরকারি সাইকেলে যাতায়াত করতে পারে। তো হানিফ সংকেত সুইজারল্যান্ডের একজন নাগরিককে প্রশ্ন করেছিলেনÑএই সাইকেলগুলো চুরি হয়ে যায় না? উত্তরে ওই ব্যক্তি আশ্চর্য হয়ে বলল, চোর কী? আর এগুলো কেনই বা মানুষ নিয়ে যাবে? সরকার যেখানে জনগণের উপকারের কথা মাথায় রেখে সাইকেলগুলো কিনে রেখেছে। এবার আসি আমাদের দেশের কথায়। কয়েক দিন আগের কথা। আমাদের এলাকার স্কুলমাঠে ইসলামী সম্মেলন হলো। রাত ১২টা পর্যন্ত চলল। পরের দিন সকালে এক ব্যক্তি এসে জানাল তার সাইকেলটি গতরাতে সম্মেলনের পাশ থেকে চুরি হয়েছে। এটা শুনে আমার পাশের লোক বলল, ‘ওই কলিম মিয়ারে গিয়া পাঁচ শ টাকা দিয়া দাও, দেখবা তোমার সাইকেল উদ্ধার হয়া যাইব।’ এই কথা শুনে প্রথম ব্যক্তি বলল, পাঁচ শ টাকা দেব মানে, আমার সাইকেল বিক্রি করলেও ভাই পাঁচ শ টাকা হবে না। এবার তাহলে বুঝুন, সুইজারল্যান্ডের জনগণের মনমানসিকতা ও আমাদের দেশের মনমানসিকতার প্রার্থক্য কত। তবে, আশার কথা হলো, বাংলাদেশের মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সেই নব্বই বা আশির দশকের কথা চিন্তা করুন। যখন ঘরের বাইরে একটি ব্লাউজ রাখলেও তা চুরি হয়ে যেত। যখন প্রতি রাতে গ্রামের বাড়িতে ডাকাত পড়ত। এমনকি ডাকাত সরদারের নাম দিয়ে ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতে চিঠি দেওয়া হতো। বলা হতো, আগামী... (একটি তারিখ লেখা থাকত) তারিখে তুর বাড়িতে আসছি, প্রস্তুত থাকিসÑএভাবে ঘোষণা দিয়ে ডাকাতি করা হতো। প্রতিরাতে এ এলাকা ওই এলাকায় মানুষের আহাজারি শোনা যেত। এককথায় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি ছিল তখনকার সময়। কিন্তু আজকের দিনে চোর বা ডাকাতের উৎপাত নেই বললেই চলে। এর কারণ কী? এর কারণ হলোÑমানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন, মানুষের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন হচ্ছে। এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে, বিশে^র উন্নত দেশগুলোয় কর প্রদান একটি স্বাভাবিক ঘটনা। জনগণ স্বেচ্ছায় এবং দায়বদ্ধতা থেকে প্রতি বছর কর প্রদান করে থাকে। আর আমাদের দেশে মাত্র কবছর আগেও ‘কর’ শব্দটির সঙ্গে এ দেশের মানুষ একদম পরিচিত ছিল না। অনেকেই কর শব্দটিকে আতঙ্কের বিষয় হিসেবে জানত। কিন্তু আজ আবস্থা পাল্টে গেছে। আজ এ দেশেও কর কোনো আতঙ্কের নাম নয়। এখন মানুষ স্বেচ্ছায় কর প্রদান করার প্রবণতা অর্জন করেছে। এমনকি আজ এ দেশে করমেলাও হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় করসেবা প্রদান ও কর সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছরের মতো এবারও দেশব্যাপী আয়কর মেলার আয়োজন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ‘উন্নয়ন ও উত্তরণ, আয়করের অর্জন’ স্লোগানকে সামনে রেখে এবারের মেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আয়কর প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধারাবাহিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ’।

গত ১৩ নভেম্বর মঙ্গলবার দেশব্যাপী করমেলা শুরু হয়েছে। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে সপ্তাহব্যাপী মেলা চলবে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত। রাজধানীর মেলা হবে মিন্টো রোডের অফিসার্স ক্লাব প্রাঙ্গণে। এ ছাড়া সব জেলা শহরে চার দিন এবং ৩২টি উপজেলায় দুই দিন মেলা হবে। পাশাপাশি ৭০টি উপজেলায় এক দিন ভ্রাম্যমাণ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। তথ্য মতে, প্রতি বছরের মতো এবারের মেলায়ও করদাতারা আয়কর বিবরণীর ফরম জমা দিতে পারবেন। নতুন করদাতারা ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ই-টিআইএন) নিতে পারবেন। আবার পুনর্নিবন্ধন করে ই-টিআইএন নেওয়ার সুযোগ রয়েছে পুরনো করদাতাদের। একই ছাদের নিচে সব সেবা মেলবে। করদাতার শুধু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে আনলেই হবে। মেলা আয়োজনের পাশাপাশি করনেট সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে জনপ্রতিনিধিদের জন্য ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা, উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস সম্প্রসারণ এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের জন্য জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান ৩৫ লাখ ই-টিআইএনধারীর সংখ্যাকে আগামী ২ বছরে ৫০ লাখে উন্নীত করা হবে। বর্তমানে মাত্র ২০ লাখ আয়কর রিটার্ন দাখিল হচ্ছে। রিটার্ন দাখিলের এই সংখ্যা ৩৫ লাখে উন্নীত করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা ও চট্টগ্রামে আয়কর মেলার আয়োজন করা হয়। এরপর প্রতি বছরই মেলার পরিধি বেড়েছে।

এবারের মেলায় সহজে রিটার্ন দাখিলের জন্য প্রতিটি করাঞ্চলের জন্য আলাদা বুথ থাকবে। ই-পেমেন্টের সুযোগ থাকবে। করদাতাদের মেলা প্রাঙ্গণে আয়কর রিটার্ন, ই-টিআইএন এবং চালান ফরম সরবরাহ করা হবে। করদাতারা মেলায় শুল্ক, ভ্যাট, সঞ্চয় অধিদফতর এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যেকোনো তথ্য জানতে পারবেন। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, প্রতিবন্ধী ও প্রবীণ করদাতাদের জন্য আলাদা বুথ থাকবে। সেরা করদাতাদের সম্মানিত

করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

এদিকে সারা দেশের আয়কর মেলায় করদাতাদের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে নতুন করদাতারা আনন্দ-উৎসাহের সঙ্গে আয়কর প্রদান করছেন, যা নিঃসন্দেহে আনন্দের বার্তা। আশা করা যায়, অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের মনমানসিকতা উন্নত দেশের মানুষের মন-মননের সমপর্যায়ে উন্নীত হবে এবং প্রতিটি সেক্টরে আসবে কাঙ্খিত পরিবর্তন। সেই সঙ্গে উন্নয়নের মাত্রাও উন্নীত হবে সর্বোচ্চ শিখরেÑএই আশাবাদ আমরা করতেই পারি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close