রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১২ নভেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

কী ভাবছে তরুণ প্রজন্ম

বিশ্বজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে চলার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তরুণসমাজকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাদের মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভাবনা ও সুপ্ত সৃজনী শক্তি রয়েছে, তা জাগিয়ে তুলতে হবে। এর জন্য চাই জ্ঞানভিত্তিক গুণগত শিক্ষা, যার আলো তাদের অন্তরকে আলোকিত করবে, সম্ভাবনা ও সুপ্তশক্তিকে উন্মোচিত করবে, আত্মবিশ্বাসী ও কর্মোদ্যোগী করে তুলবে। আমরা জানি, জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান সৃজনী শক্তিকে পরিপুষ্ট করে, উন্নয়নের সিঁড়িকে করে মজবুত। জ্ঞানান্বেষণের প্রবল ইচ্ছা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্ম দেয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা যেমন অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত তৈরি করে, তেমনই নৈতিক শিক্ষাসভ্যতা ও সুশাসনের ভিতকে শক্তিশালী করে। জ্ঞানার্জনের ফলে তরুণরা নীতিনৈতিকতায়, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠবে। তারা তখন তাদের পছন্দনীয় কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিতে পারবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্মী, ব্যবস্থাপক ও উদ্যোক্তা হিসেবে ছড়িয়ে পড়বে। উন্নয়নের বহুমুখী খাতগুলো তারুণ্যের পদচারণে মুখর হয়ে উঠবে। দেশে এখন তরুণসমাজের খুবই দুঃসময় চলছে। তাদের মধ্যে অনেক ঘাটতি ও হতাশা বিরাজ করছে। গুণগত শিক্ষায় পশ্চাদপদতা, জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার অভাব, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দুর্বলতা, অপুষ্টি, চাকরি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব, এসব সমস্যা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনার দ্বারকে রুদ্ধ করে রেখেছে। এ ছাড়া নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপরাজনীতির শিকার, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, মাদকাসক্তি, প্রভৃতি কারণে বহু তরুণ আজ বিপথগামী হয়ে পড়ছে।

দেশে আজ সুশাসন ও নীতিনৈতিকতার বড়ই অভাব। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। আদর্শ নেতৃত্বের অভাবে লুটেরা রাজনীতি দেশে অবাধ, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। দলীয় ও গোষ্ঠীগত চেতনায় জাতীয় চেতনাবোধ অবলুপ্ত প্রায়। ফলে দেশের তরুণ ও যুবসমাজ আজ বিভ্রান্তি ও হতাশায় নিমজ্জিত। একটি উন্নয়নকামী সভ্য দেশের জন্য এ অবস্থা মোটেই কাম্য নয়। সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের তরুণসমাজকে নোংরা রাজনীতি, সন্ত্রাস, নেশা ও কালোটাকার ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে। তাদের হাতে মাদক ও অস্ত্রের বদলে জ্ঞানের মশাল তোলে দিতে হবে। উদীয়মান তরুণ প্রজন্ম এখন দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের বর্তমান মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ যাদের বয়স ১০ থেকে ২৪ বছর। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ তরুণদের সংখ্যা ১০ থেকে ১৯ শতাংশে নেমে আসবে। ফলে তখন কর্মক্ষম নবীনের সংখ্যা স্বল্পতা দেখা দেবে। তাই আজকের এ বিশাল কর্মক্ষম ও উদ্যমী তরুণ প্রজন্মের সামনে বিরাট সম্ভাবনা ও সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এ সম্ভাবনাময় তরুণ জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার এখনই উপযুক্ত সময়। দেশের উন্নয়নের অভিযাত্রায় এরাই অগ্রণী সৈনিকের ভূমিকা পালন করবে। অতীতে দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণ ও যুবসমাজ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

তরুণসমাজ তাদের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারবে। তারুণ্য একটি প্রবল প্রাণশক্তি, যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা উজ্জীবিত থাকে। একটি স্ফুলিঙ্গ তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত শিখায় পরিণত করতে পারে, যা হয়ে উঠতে পারে নক্ষত্রের মতো সমুজ্জ্বল। এ জন্য প্রয়োজন একটি স্বপ্নেরÑযে স্বপ্ন তরুণসমাজকে একটি সুন্দর সফল জীবনের পথ দেখাবে। প্রতিটি তরুণেরই এরূপ একটি স্বপ্ন থাকা চাই উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন। কিছুদিন আগে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালাম ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০ শিক্ষার্থীদের সামনে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, তোমাদের স্বপ্নগুলো হবে বাংলাদেশের স্বপ্ন, তোমাদের ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা এবং তোমাদের কাজগুলো হবে বাংলাদেশের কাজ। তাদের স্বপ্নে, চিন্তাভাবনায় এবং কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে দেশ ও আপামর জনগণের শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ। এসব তরুণই হবে জাতির মেরুদ-। এ মেরুদ-কে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কাজে অভিভাবক, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সঠিক পরিচর্যা পেলে এক দিন তারাই তাদের মহৎ স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে।

তরুণ বয়সটাই জ্ঞান সাধনার বয়স, নিজেকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের উপযুক্ত নাগরিক ও কর্মবীর হিসেবে গড়ে তোলার সময়। বিজ্ঞানের কল্যাণে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয় এসে গেছে। বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রার যুগে ইন্টারনেটে যে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুবর্ণ দ্বার উদ্ঘাটিত হয়েছে, এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করবে আমাদের তরুণসমাজ। তরুণরা তাদের জ্ঞানতৃষ্ণাকে শানিত করবে, অধ্যয়ন ও গবেষণায় ব্রতী হবে এবং মেধা, জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তির ঘটাবে স্ফুরণ। নব নব আবিষ্কারের দ্বারা দেশ ও মানবতার কল্যাণ সাধন করবে তারা। তাদের মন-মস্তিষ্ককে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হবে। উন্নত নীতিনৈতিকতা দ্বারা তারা নিজেদের সৎ, সাহসী ও সংগ্রামী মানুষে পরিণত করবে। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকা-ে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগকে অবারিত করে দিতে হবে। যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করবে। সত্যিকার মানুষ হিসেবে সব কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির জঞ্জাল সরিয়ে তারা নিজেদের আলোকিত করতে পারবে। এভাবে জীবনকে গড়ার মধ্য দিয়ে তারা একদিন উন্নয়নের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হবে এবং দেশ ও জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮ দেশের মধ্যে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম, শিক্ষায় ২৫তম, উদ্ভাবনে ২৭তম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ২৬তম। এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো সুখকর চিত্র নয়। তবু এটা বলতে বাধা নেই, বাংলাদেশের তরুণসমাজের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। প্রকৃতগতভাবেই আমাদের তরুণরা মেধাবী ও কর্মঠ, তারা দ্রুত শিখতে পারে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। সম্প্রতি দেশ-বিদেশে তারা তাদের মেধা ও সৃজনী শক্তির চমক দেখাতে সক্ষম হচ্ছে। গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায়ও আমাদের শিক্ষার্থীরা সাফল্য অর্জন করছে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কম্পিউটার বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অনেক উন্নত দেশের শিক্ষার্থীদেরও পেছনে ফেলে দিয়েছে। তবে এটা দুঃখজনক, সুযোগের অভাবে দেশ থেকে শ্রেষ্ঠ মেধার অধিকারী অনেক তরুণ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সৎ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থানের। দেশে প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরিপ্রাপ্তির সুযোগ অতি অল্প। সরকারি ও বেসরকারি খাতে তৈরি করতে হবে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ। তাদের শুধু চাকরিতে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে। প্রথমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের যাত্রা শুরু হবে। ক্রমেই বৃহৎ ব্যবসা,-বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠায় তারা এগিয়ে যাবে। এসব উদ্যোগের দ্বারা তারা তাদেরই মতো অগণিত তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ লক্ষ্যে চাই তাদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং পুঁজি ও পরামর্শ। উচ্চতর কারিগরি প্রযুক্তি ও কর্মকৌশল আয়ত্ত করতে হলে প্রযোজন গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। এর জন্য দরকার ব্যাপক বিনিয়োগ। আর্থ-সামাজিক খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করে। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে তা কখনো বিফলে যাবে না, বরং অর্থনীতির চাকা সচল হয়ে উঠবে, দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। ক্রমবর্ধমান সক্ষমতা ও সুযোগ উন্নয়ন চক্রকে সুগম করে তুলবে। তরুণসমাজের উন্নয়ন হলে জাতির মেরুদ- শক্তিশালী হয়ে উঠবে, দেশ ও জাতি সমৃদ্ধির পথে এগোবে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই উন্নয়ন সহায়ক ও আশাব্যঞ্জক নয়।

জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক আমাদের তরুণসমাজ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাই পারে সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে। তরুণরাই এ ঘুণে ধরা সমাজের পরিবর্তন ও দিনবদলের নিয়ামক শক্তি হতে পারে। দেশবাসীর আশা পূরণে তারা এমন একটি সুস্থ, সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে থাকবে না কোনো দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অসাম্য এবং শোষণ। ন্যায় ও সম্প্রীতির ওপর ভিত্তি করে সব ধরনের ভেদাভেদমুক্ত একটি সমাজ গড়বে তারা। দেশ ও জাতিকে তারা উপহার দেবে একটি শান্তি ও সৌহার্দ্যময় পরিবেশ। বিশ্বের বুকে দেশকে একটি মর্যাদাশীল আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতির ফলে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে সর্বত্র। এ পরিবর্তন যেমন একদিকে কল্যাণ বয়ে আনছে, অন্যদিকে বিপর্যয়ও ডেকে আনছে। পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, বিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার, নব্য আধিপত্যবাদী আগ্রাসন, জঙ্গিবাদ, প্রাণঘাতী রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। মানুষের ভোগবাদী প্রবণতা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদকে উজাড় করে দিচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির দৌরাত্ম্যে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য পাহাড়সম রূপ ধারণ করছে। এক শ্রেণির মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমছে, অন্যদিকে অগণিত দরিদ্র ও বুভুক্ষু মানুষের হাহাকারে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে তরুণসমাজকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন ধ্যান-ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নতুন রূপরেখা তৈরি করবে তরুণরা। অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, নেতৃত্ব দেবে এবং এগিয়ে যাবে তারা।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close