সাধন সরকার

  ০৪ নভেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি

জলবায়ু পরিবর্তন এখন অলীক কোনো বিষয় নয়। বহু আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন যে পৃথিবীজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার উপকূলীয় দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ বৈশি^ক উষ্ণায়ন। উন্নত দেশগুলোয় শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত অতিমাত্রায় আরাম-আয়েশের ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্বন ডাই-অক্সাইড তথা গ্রিন হাউস গ্যাসের ব্যাপক নির্গমন ঘটছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড তাপ ধরে রেখে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে জলবায়ুর অস্বাভাবিক আচরণ। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে গ্রিনল্যান্ডের বরফ অনেক আগেই গলতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীদের নতুন গবেষণা বলছে দক্ষিণ মেরুর অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের বরফও গলতে শুরু করেছে। সর্বোপরি পৃথিবীজুড়ে বিস্তীর্ণ বরফ খন্ডের ক্ষয় হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গঠিত আন্তরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি) ২১০০ সাল পর্যন্ত সময়কে বিবেচনায় নিয়ে আইপিসিসির সর্বশেষ মূল্যায়নে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ ও হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে গাছপালা, প্রাণীর আবাসস্থল সর্বোপরি জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে। ধারণাতীত উচ্চতা বৃদ্ধির আশষ্কায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে উপকূলীয় শহর ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি শুধু যে উপকূলীয় ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে তা নয়, কমবেশি অন্য সব দেশগুলোর ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মানুষের বিভিন্ন অসচেতন কর্মকান্ডও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য কম দায়ী নয়! উন্নত বিশে^র পরিবেশ-বিধ্বংসী উন্নয়ন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে একবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই ফুটের বেশিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশসহ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইনসহ প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো তলিয়ে যেতে পারে।

পৃথিবীর ব্যাপক জনসংখ্যাবহুল বৃহৎ বেশ কয়েকটি মেগাসিটি সমুদ্রতীরের কাছাকাছি অবস্থিত। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় ও দ্বীপরাষ্ট্রসহ সব মিলিয়ে পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামুদ্রিক সীমানাও পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। ফলে সমুদ্রসীমা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে দেখা দিতে পারে বিরোধ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশে দেশে মিঠাপানির সংকট দেখা দেবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সামুদ্রিক প্রাণী ও সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকি তৈরি হবে। ফলে পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সামগ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সারা বিশে^র যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নামক পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ অন্যতম। গবেষকরা বলছেন, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ যদি এখনই বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলেও এরই মধ্যে আমরা পরিবেশের এতটাই ক্ষতি করে ফেলেছি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আগামী কয়েক দশকে বেড়েই যাবে! সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভিদ-প্রাণী তথা জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে ও হবে। উপকূলের গাছপালা ও প্রাণ-প্রতিবেশের ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকার সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) অন্য এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ ভাগ উপকূলীয় স্থলভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। ফলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে (প্রতি সাতজনে একজন)। নাসার সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি শতকে চট্টগ্রাম বন্দরও সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে! সীমিত সম্পদ ও বিপুল জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে জলবায়ু-উদ্বাস্তুরা সবকিছু হারিয়ে বাড়তি সমস্যা তৈরি করবে। কাজের সন্ধানে শহরে এসে ভিড় জমাবে। তাই কার্বন নিঃসরণকারী উন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক কাতারে এসে দায় নিয়ে ‘প্যারিস চুক্তির’ শর্ত মেনে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ^কে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে বিকল্পব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির (সৌরশক্তি, পানিশক্তি, বায়ুশক্তি) দিকে প্রতিটি দেশকে অগ্রসর হতে হবে এবং একই সঙ্গে সবুজায়ন বাড়াতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close