শফিকুল ইসলাম খোকন

  ৩১ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

নৈরাজ্যের লাগাম টেনে ধরুন

তোমার পরনে সাদা পোশাক? সাদা পোশাকে কালি কেন? তুমি কি কোনো অপরাধ করেছ? বাংলাদেশে জন্মে পাপ করেছ! তাই কি তোমার জামায় কালি? পরিবহন ধর্মঘট চলছে, তাতে তোমার কী? হয়তো এমন প্রশ্ন এখন সবার মনে। সাদা স্কুল বা কলেজ ড্রেস পরা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে অসহায় দৃষ্টি মেলে। ওর পোশাকে লেগে আছে ছোপ ছোপ কালির দাগ। হতভম্ব মেয়েটির চোখের দৃষ্টি দেখেই বোঝা যায়, বিস্ময়ে সে বিমূঢ় হয়ে গেছে। হয়ে গেছে বাকশক্তি রহিত। বিস্ময় ভরা চোখে যেন তার প্রশ্নÑএ কোন সমাজে সে বাস করছে? দেশজুড়ে চলছে পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘট। এ ধর্মঘটের ফলে অপরিসীম ভোগান্তির মুখে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সংসদে সদ্য পাস হওয়া ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ আট দফা দাবিতে সারা দেশে চলছে পরিবহন ধর্মঘট। আর এ ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

এ লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। আবার মনে হয়েছিল আমি তো অপরাধ করিনি, তাহলে কেন নিজেকে অপরাধী মনে করব? আবার নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি যে, আমি তো একজন নাগরিক, সচেতন; তাহলে কেন অপরাধী নয়? একটি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন সাত দিনের অবুঝ শিশুর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আর স্কুলগামী শিক্ষার্থী সাদা পোশাকে কালি মাখিয়ে দেওয়া হয় তখন অপরাধী ছাড়া কী বলার আছে। আমরা জানি, ইতিহাসে যত বড় আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছে, তার মধ্যে রোগী বহনকারী অ্যা¤¦ুলেন্স, বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী, ফার্মেসি, হাসপাতাল এবং গণমাধ্যম কর্মী উন্মুক্ত থাকেন। কিন্তু এ আন্দোলনে দেখেছি ঠিক তার উল্টোটা। কিন্তু কেন? এর উত্তরই কার কাছে আছে? কে দিতে পারবে উত্তর? তবে এ মুহূর্তে উত্তর চাই না, এর লাগাম টেনে ধরা উচিত, রাজপথের নৈরাজ্য বন্ধ করা উচিত। অনেক হয়েছে। এবার লাগাম টেনে ধরুন, নৈরাজ্য বন্ধ করুন। দয়াকরে এবার থামতে বলুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অনেক ভালো কাজের পাশাপাশি আপনার সরকারের যতখানি সমালোচনা রয়েছে আর সেই সমালোচনা হয়েছে আপনারই অধীনস্ত কিছুসংখ্যক এমপি ও মন্ত্রী আর নেতাদের কারণে। সাদা পোশাকে কালি, শিশুর মৃত্যু এ দায় কার? কে নেবে এর দায়ভার? সব কিছু ঘুরে-ফিরে বর্তায় আপনারই ওপর।

বহুবারই সড়কে শ্রমিকদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। প্রায় প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে চলেছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু কখনো দেখা যায়নি এসব শ্রমিক বা শ্রমিক সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করায় বিচারের দাবিতে আন্দোলন, সংগ্রাম এবং ধর্মঘট করেছে। অথচ এসব দুর্ঘটনার তদন্ত এবং বিশ্লেষণ করে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং বেপরোয়া গতিতে যান চালনাসহ ফিটনেসবিহীন যানবাহন দায়ী বলেই সামনে এসেছে। তদন্তসংশ্লিষ্টদের পরামর্শ ছিল আইনের কঠোরতা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা গেলে সড়কে দুর্ঘটনার মাত্রা কমে আসতে পারে। দেশের নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে যাত্রী কল্যাণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতাসহ সুশীল সমাজেরও দাবি ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের। সড়ক দুর্ঘটনার অপরাধ হবে জামিন ও আপসযোগ্য, এমন দাবিও ছিল জনগণের। কিন্তু এসব গণদাবির বেশির ভাগই আইনে আসেনি। এর পরও সাম্প্রতিক আইনের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন। সঙ্গত কারণেই শ্রমিকদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গণমাধ্যমে নানা জনসচেতনতামূলক কাযর্ক্রম গ্রহণ করা সত্ত্বেও দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। পরিসংখ্যান মতে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ১৫ থেকে ২২ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে। আবারও ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। এক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ৩৩৪৯টি। ২০১৭ সালের এসব দুর্ঘটনায় সারা দেশে নিহত হয়েছে ৫৬৪৫ জন এবং আহত হয়েছে ৭৯০৮ জন। গড়ে প্রতিদিন ১৫ জন নিহত হয়েছে। নিরাপদ সড়ক চাই এর তথ্য অনুযায়ী দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে ৬০ লাখ। এসব গাড়ির চালকের মাধ্যমেই যত্রতত্র পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটছে। ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। এ বছর সারা দেশে ২৬২৬টি দুর্ঘটনায় ৫০০৩ জন নিহত ও ৬১৯৭ জন আহত হয়। ২০১৬ সালে আরো কমে ২৩১৬টি দুর্ঘটনায় ৪১৪৪ জন নিহত ও ৫২২৫ জন আহত হয়।

আমরা জানি, একটি আইন হয় দেশের সব নাগরিকের জন্য এবং সর্বজনীন। ঠিক তেমনি সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সেভাবেই হয়েছে। তবে এ আইন নিয়ে অনেকেই অনেক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এ আইনে দেখা গেছে, সব বিষয় উঠে আসেনি। সেখানে শুধু শাস্তির বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সবার আগে গাড়িচালক ও যাত্রীদের সচেতনতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা নিরসন করতে হলে প্রথমে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশিক্ষিত চালক, অনুমোদিত গাড়ি, নিরাপদ রাস্তাসহ সব রকমের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। দুর্ঘটনার জন্য জেল-জরিমানাতে সমাধান নয়, সমাধান এর কারণ উদঘাটন করে তা লাঘব করা। দুঃখজনক হলেও এত আইন থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রতিকার দেখা যাযনি। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও মোট জিডিপির ২ ভাগ। চলতে হলে আইনেরও প্রয়োজন রয়েছে। তবে আইনের আগে আমাদের সবার যেমন সচেতন হওয়া উচিত, তেমনি গাড়ির মালিক, চালক, যাত্রী তথা পথচারীদেরও সচেতন হতে হবে। ট্রাফিক আইন না মানা, ডান-বাম না দেখে বিপথে যানবাহন চালানো, বেপরোয়া ড্রাইভার ইত্যাদি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার অন্যতম কারণ। দুঃখজনক হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের তেমন শাস্তি হয় না। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের পাশাপাশি পথচারীদের দায় রয়েছে, সে কারণে পথচারীদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত। আশার কথা যে, এই প্রথম সড়ক পরিবহন আইনে যানবাহন চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান রাখা হয়েছে ন্যূনতম ৮ম শ্রেণি এবং সহকারীর যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি পাস। আইনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হলে ৩০২ ধারা প্রযোজ্য হবে। যাতে শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আর খুন নয়Ñ এমন ঘটনায় ৩০৪ ধারা অনুযায়ী সাজা দেওয়া যাবে যাবজ্জীবন। আর শুধু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৩০৪ (খ) এর জন্য তিন বছরের কারাদন্ড। অথচ এসব ধারা পরিবর্তনের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন শ্রমিকরা। এর চেয়ে পরিতাপের আর কী হতে পারে।

একটি আইন হলে ওই আইন নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা, ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা শুরু হয়। আইনের ধারা বা উপধারার প্রতি আমাদের বিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু ওই আইন সংশোধনের জন্য এ রকমের আন্দোলন মোটেই কাম্য নয়। আন্দোলন ছাড়াও এ আইনের বিষয় সরকারের নজরে আনা যেতে পারে বিভিন্নভাবে। শ্রমিকদের বেলায় ছোটখাটো বিষয় নিয়েই সড়ক অবরোধ, ধর্মঘট। এ প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন আসে সরকারের কাছে কি শ্রমিক নতজানু, না শ্রমিকদের কাছে সরকার নতজানু? তাহলে কেন তো নৈরাজ্য? সর্বোপরি বলতে চাই, মালিক-শ্রমিকের চাপের কাছে সরকার নতজানু হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার বিষয়টি কথার কথা হয়েই থাকবে। যা দেশবাসী প্রত্যাশা করে না। ধারা পরিবর্তন মানে সড়কে ‘মৃত্যুর বৈধতা দাবি’, যখন এমন বিষয় সামনে আসছে; তখন শ্রমিকদের খুঁটির জোর কোথায় তা শনাক্ত করে সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার, কার্যকর উদ্যোগ নেয়। জনগণকে জিম্মি করে এই অচলাবস্থার অবসান ঘটুকÑ এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close