রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ অক্টোবর, ২০১৮

ব্রিটেন

নতুন অভিবাসন পরিকল্পনায়

ইউরোপীয় ইকোনমিক জোনের চলার পথে ৭৩ সালে সংযুক্ত হয় যুক্তরাজ্য। ৪৩ বছরের মাথায় তাদের চলার গতি থমকে গেল। ২৩ জুন ১৬ সালে এক ঐতিহাসিক গণভোটে যুক্তরাজ্যকে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ব্রিটিশরা। লেবার সরকারের হ-য-ব-র-ল মার্কা ইমিগ্রেশন নীতি টরিদের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দেয় এবং লিব ডেমের সঙ্গে দুর্বল কোয়ালিশন করে সামনে চলতে থাকে। পূর্ব ইউরোপসহ পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের ইমিগ্র্যান্টদের ব্রিটেনে আসার স্রোতও অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়; ব্রিটিশদের সোশ্যাল সার্ভিস ও মেডিকেল সুবিধা নিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আগত ইউরোপীয়দের কারণে; হসপিটালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য ব্রিটিশরা সিট পায় নাÑএমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। নতুন জেনারেশন না হলেও যাদের কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে শক্ত ভিতের ওপর ব্রিটেন দাঁড়িয়েছে, তারা বিষয়টি সহজে মানতে পারছিল না। মার্চ ২০১৭ থেকে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শুরু এবং লিসবন চুক্তির ৫০নং ধারা কার্যকরের মাধ্যমে বেরিয়ে আসার সব প্রস্তুতি নিচ্ছেন তেরেসা মে। গত ৪ মে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় কারি ইন্ডাস্ট্রিতে এ অস্বস্তির এক বিশদ চিত্র ফুটে উঠেছে। ব্রেক্সিট নেটিভ ব্রিটিশদের জন্য সাময়িকভাবে ভালো হলেও সার্বিক বিবেচনায় তেমন সুখকর বার্তা নিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। ব্রেক্সিট সফলভাবে ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হলে নতুন অভিবাসী যেমন কমবে, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীলদের উগ্রতাও অনেকটা বেড়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে ডিফেন্স লিগের মতো সরাসরি অভিবাসনবিরোধীরা মাঠে সক্রিয়। তাদের সমর্থনে ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি কাজ করে চলেছে।

বর্তমানে উইন্ডরাশ জেনারেশন নিয়ে বিপাকে পড়ার পর ইমিগ্রেশন নীতিতে কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করেছে যুক্তরাজ্যের হোম অফিস। উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারীর পর অবৈধ অভিবাসীদের ধরার লক্ষ্যে পূর্ব ঘোষিত প্রায় সাত কোটি ব্যাংক একাউন্ট পরীক্ষা-নীরিক্ষার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন নতুন ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ। এ ছাড়াও উইন্ডরাশ জেনারেশনের নাগরিকত্বের আবেদন ফাস্ট ট্র্যাকে এবং বিনা পয়সায় করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। গত এপ্রিলে কমনওয়েলথ সামিট না হলে হয়তো হোম অফিসের উইন্ডরাশ জেনারেশন কেলেঙ্কারির ঘটনা আড়ালেই থেকে যেতে। ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটির সঙ্গে বর্তমান সরকারের চরম বৈরিতার এই গোপন বিষয়টি ধরা পড়ার পর কিছুটা ইউটার্ন করেছে হোম অফিস অবৈধ অভিবাসীদের আটক করার জন্য প্রায় ৭০ মিলিয়ন কারেন্ট একাউন্ট চেক করার পরিকল্পনা থেকেও সরে আসার ঘোষণা দেন নতুন হোম সেক্রেটার সাজিদ জাভিদ। ২০১৬ সালের ইমিগ্রেশন আইনে ডাক্তারের কাছে এবং ব্যাংক ম্যানেজারদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, অবৈধদের চিহ্নিত করার; যা ছিল খুবই অমানবিক। তবে ইমিগ্রেশন নীতি নিয়ে বর্তমান সরকারের ভেতরেই ভিন্ন মত রয়েছে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যারা যুক্তরাজ্যে অবৈধ হিসেবে রয়েছে এবং যাদের কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তাদের অ্যামনেস্টি দেওয়ার পক্ষে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন বর্তমান ফরেন সেক্রেটারি বরিস জনসন এবং দিন দিন এই দাবি জোরালো হচ্ছে। একই দাবিতে একটি অনলাইন পিটিশনেও স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ব্রিটিশ বাংলাদেশি কারিশিল্পকে রক্ষার তাগিদে কঠোর ইমিগ্রেশন নীতি পরিবর্তনের দাবিতেও একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর সংগ্রহ চলছে। এই ক্যাম্পেইনটি শুরু করেছে বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন সংক্ষেপে বিসিএ। ব্রিটিশ বাংলাদেশি কারি ইন্ডাস্ট্র্রি বর্তমানে চরম সংকটে আছে। এই সংকটের অন্যতম একটি কারণ হলো বর্তমান সরকারের কঠোর ইমিগ্রেশন নীতি। তাই এই পিটিশনে যত বেশি স্বাক্ষর হবে, তত বেশি লাভ হবে কারিশিল্পের। যেহেতু হোম অফিস এখনো একটু চাপের মধ্যে আছে এবং ব্রেক্সিটে পরে কমনওলেথ ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেই ব্রিটেন আবার সখ্যতা গড়ার চেষ্টা করবে। তাই এই দুটি পিটিশনেই স্বাক্ষর করার সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অভিবাসী কমিউনিটির প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ শুরু করে টোরি সরকার। ভ্যানে বিজ্ঞাপন বোর্ড টানিয়ে ইলিগ্যাল মাইগ্র্যান্টদের যুক্তরাজ্য ত্যাগের আহ্বান, অবৈধদের থাকার জায়গা দিলে বা কাজ দিলে মালিকের ওপর জরিমানা আরোপ, অবৈধদের ধরার জন্যে জিপি এবং ব্যাংকারদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা সবই হয়েছে এই টোরি সরকারের আমলে। আর বর্তমান হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ এবং সদ্য পদত্যাগি হোম সেক্রেটারি এম্বার রাডের আগে সেই ২০১০ সাল থেকে টোরির হোম সেক্রেটারি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। প্রধানমন্ত্রী থেরেসাা হোম সেক্রেটারি থাকা অবস্থায় প্রায় ৫৮ হাজার নন-ইউ স্টুডেন্টকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয় টোয়িক ইস্যুতে। পরবর্তীতে আদালতে এই সিদ্ধান্তটিও বারবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটেনে অবৈধভাবে বসবাসকারীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সাধারণ ক্ষমার। যদি কপাল খোলে তাদের।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ব্রেক্সিট কার্যকর হলে দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হবে। ইইউর শ্রমিকদের আর একপেশে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। এদিকে লো স্কিল ওয়ার্কারদের কাজের সুযোগ দিতে মাইগ্রেশন অ্যাডভাইজারি কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা সমর্থন করেছে লেবার পার্টি। এবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর স্পষ্ট হচ্ছে ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পর শুধুমাত্র ইইউ থেকে কর্মী নেবে না। যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে ব্রিটেনে কাজের সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে আবারও ভাগ্য খুলতে পারে বাংলাদেশি স্টেুরেন্ট শ্রমিকদের। ভাগ্য খুলতে যাচ্ছে স্টুডেন্ট হিসেবে ব্রিটেনে আসতে যাওয়া। নতুন পরিবর্তনগুলোর মধ্যে থাকছে, স্টুডেন্টদের আর ইমিগ্রেন্ট হিসেবে দেখা হবে না। ওয়ার্কার হিসেবে এ দেশে কাজ করতে হলে তাকে মিনিমাম বেতনে কাজ করতে হবে। তবে এটা দেখা হবে সে স্থায়ী বাসিন্দাদের কাজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে কি না? স্কিল ওয়ার্কাররা তাদের ফ্যামিলি দেশ থেকে নিয়ে আসতে পারবে। তবে তাদের ভবিষ্যত কাজের স্পন্সর দেখাতে হবে। অন্যদিকে সিকিউরিটি এবং ক্রিমিনাল রেকর্ড পরিক্ষায় আমেরিকার মতো কড়াকড়ি করা হবে বলেও উল্লেখ রয়েছ। প্রধানমন্ত্রী মে সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পর উচ্চমান ও যোগ্যতাসম্পন্ন অভিবাসীদের আকৃষ্ট করবে। এমনকি যেকোনো দেশের অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ দেওয়া হবে। ২০১৯ সালে ব্রেক্সিট বিল প্রকাশের আগেই আমরা ইইউ ও ইইউ বহির্ভূত দেশগুলোর জন্য একটি একক নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছি’ বলে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির একটি সমাবেশে দাবি করা হয়। মে আরো বলেন, আমরা বিশেষত অভিবাসন ইস্যুতে ব্রেক্সিট চাই। তাই কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মত ব্রিটেন অভিবাসী বাছাই করার সুযোগ পাচ্ছে। এমনকি ব্রেক্সিটের সঙ্গে সঙ্গে ইইউর নাগরিকদের ফ্রি ব্রিটেন ভ্রমণ করার সুযোগও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজনেই শুধু অভিবাসন প্রবেশ করাব।

ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায় ব্রেক্সিট পরবর্তী অভিবাসন নীতি অনুমোদন ব্রেক্সিটের করেছে। এই নীতির আওতায় দক্ষতা ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় ভিসা দেওয়া হবে। আগামী সপ্তাহে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে তার নতুন অভিবাসন নীতি তুলে ধরবেন। ডাউনিং স্ট্রিট আশা করছে, দলের যেসব সদস্য তেরেসা মের নেতৃত্ব ও ব্রেক্সিট নিয়ে দর কষাকষির সক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন, নতুন অভিবাসী নীতি তাদের পছন্দ হতে পারে। মের অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার নিজের ব্রেক্সিট পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মের নিজস্ব বেক্সিট পরিকল্পনাটি চেকার্স পরিকল্পনা নামে পরিচিত। ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ জানিয়ে দিয়েছেন চেকার্স পরিকল্পনাটি বাস্তবসম্মত নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ মে সরকারের অভিবাসন পরিকল্পনাটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করেন। এতে বলা হয়েছে, দক্ষ শ্রমিকরা সহজেই ব্রিটেনে প্রবেশের ভিসা পাবেন। তবে ইইউ দেশগুলো থেকে আসা অদক্ষ শ্রমিকরা কোনো অগ্রাধিকার পাবে না। ইইউসহ যেসব দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করবে, সেসব দেশের শ্রমিকদের ব্রিটিশ শ্রমবাজারে ঢোকার সুযোগ থাকবে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ আরো কয়েকটি দেশ এই চুক্তির মধ্যে আসতে পারে। বৈঠকে ব্রেক্সিট আলোচনা নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়নি। তবে মের পরিকল্পনাবিরোধী অংশটি তার ওই পরিকল্পনা বাদ দেওয়ার জন্য চাপ দেন। এ বিষয়ে কানাডা স্টাইলের একটি চুক্তি করার কথাও আসে। কানাডা স্টাইল চুক্তির কথা বলেন স্বয়ং মে। তিনি তার বক্তব্যে ইইউ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার আলোচনার কথা

উল্লেখ করে বলেন, এখানে উপস্থিতি অনেকের চেয়ে ইইউ নেতৃবৃন্দ ছিলেন বেশি গঠনমূলক। তবে কোনো ইইউ নেতৃবৃন্দ গঠনমূলক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সেটি মে স্পষ্ট করে বলেননি।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close