ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ

  ২২ এপ্রিল, ২০১৮

বিশ্লেষণ

আত্মকর্মসংস্থানের বিকল্প নেই

বাঙালির গৌরবের বছর ১৯৭১। নিজের পরিচয়ে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এই জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে প্রমাণ করেছিল, ‘এ জাতির মাথা নোয়াবার নয়’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি স্বপ্ন ছিল। একটি স্বপ্ন নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের মুক্তিকামী মানুষ। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ শিক্ষা, ক্রীড়া, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অনেক ক্ষেত্রেই অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। মেঘনা, যমুনা সেতুসহ অসংখ্য বড় সেতু নির্মিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু নির্মাণ করছেন। কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা একটি দেশ ও জাতিকে স্বাবলম্বিতা অর্জনের ক্ষেত্রে মূল উপজীব্য হিসেবে যে কত বড় কাজ করে পদ্মা সেতুই তার প্রমাণ।

১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখন আমার সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে প্রকৃত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী সমাজ গঠন করা।’ কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপদগামী কিছু সদস্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশ চলে যায় এক অনিশ্চয়তার পথে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, অনেক বাধাবিঘœ অতিক্রম করে বাংলাদেশ পুনরায় ফিরে আসে গণতন্ত্রের পথে। এ কথা বলাই বাহুল্য, গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় বিরোধী দল বা দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সংসদীয় বিরোধী দলের ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার সুফল জনগণ পেতে শুরু করেছিল, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে, দাতা দেশগুলো এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার ভাব সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা বলিষ্ঠতর হয়েছে।

সবুজ অভয়ারণ্য, সুজলা-সুফলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অপূর্ব মিলনমেলা হচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এ দেশে রয়েছে বহু প্রাকৃতিক সম্পদ। সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানবসম্পদ। বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। অপরূপ মায়াবী নজরকাড়া আমাদের দেশের বাইরে ও ভেতরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বহুবার এবং আজও বিভিন্নভাবে চলছে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে থাকবে না মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, থাকবে না সামাজিক কোন্দল, গুম-হত্যা, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি। অন্যদিকে থাকবে ধর্মীয় অনুভূতি, শিক্ষাঙ্গনে থাকবে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, যেখানে থাকবে না অবৈধ স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, অস্ত্রের ঝনঝনানি। আগামীর বাংলাদেশ চাই অর্থনৈতিকভাবে প্রবৃদ্ধি সাধন, যেখানে থাকবে না লুটতরাজ, সুদ-ঘুষ ও সীমাহীন দুর্নীতি। জাতি আগামীর বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে থাকবে না জুলুম-নিপীড়ন। সবাই একে অন্যের প্রতি আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল হবে। স্বাধীন বাংলার মানুষ আরো দেখতে চায় শিল্প বিপ্লবের স্বর্ণালি যুগ, রফতানিমুখর দেশীয় পণ্য, চোরাচালানহীন সীমান্তপথ, প্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদদের মতে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তরুণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশের সামনেও সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হবে কি নাÑতা নির্ভর করছে সৃষ্ট সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে তার ওপর। বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সমস্যা হলো জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার। যুব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অভিভাবকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যুবসমাজের কর্মসংস্থানের যথাযথ পদক্ষেপ যেমন দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে, তেমনি এ ক্ষেত্রের ব্যর্থতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থেই কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গতি আনার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশির ভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও।

পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বেই কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সঠিক হবে না। তাই অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে। সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে এ দেশের যুবকরা। অনেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। ফলে সমাজে সম্ভাবনার ক্ষেত্র আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে। আসলে যুবসমাজই হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়তে দেশের এই বিশাল শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার হওয়া দরকার। এরাই নিজেদের মেধা ও মনন শক্তি ব্যবহার করে নির্ধারণ করবে দেশের আগামী দিনের চলার পথ। তাই সমাজের এই সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী অংশকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। এ জন্য যুবসমাজের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও কর্মের জোগান দিতে হবে। যুবসমাজের অমিত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তাই প্রবাসে নয়, স্বদেশেই কর্মসংস্থান নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে সুখী-সমৃদ্ধিশালী ও আদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist