শামীম শিকদার

  ২৯ মার্চ, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ফুটপাতে মোটরসাইকেল

ঢাকায় প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। এতে তীব্র যানজটে দিশাহারা হচ্ছে নগরবাসী। সিগন্যালে আটকা পড়ে কর্মব্যস্ত মানুষের পথেই নষ্ট হচ্ছে অনেকটা সময়। মহানগর পুলিশ প্রশাসন ও বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর সড়কগুলোয় যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করার ব্যবস্থা রয়েছে, এর ১০ গুণ বেশি যানবাহন চলে। এ দুর্ভোগের পাশাপাশি রাজধানীতে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোটরসাইকেল। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নগরীতে অনেকটা বেপরোয়া গতিতে চলছেন মোটরসাইকেলের চালকরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা সিগন্যাল তো দূরের কথা ভিআইপি সিগন্যালও মানছেন না। আর রাজধানীর অধিকাংশ সড়কের ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ফুটপাতে মোটরবাইক চলাচল করায় প্রায়ই ঘটছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা। ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হাইকোর্টের রায় থাকলেও তা কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

গত বছরের প্রথমদিকে মন্ত্রিসভায় একটি খসড়া আইন পাস করেছিল, যাতে বলা হয়েছে ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালালে তিন মাসের জেল ও জরিমানা হবে। তা ছাড়া ২০১২ সালের ৫ মার্চ হাইকোর্ট ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল করতে না দিতে মহানগর পুলিশকে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর পরও বন্ধ হয়নি ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল। তার ওপর আছে হকারদের দৌরাত্ম্য। নিরুপায় পথচারীরা তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন ব্যস্ত রাজপথে। মোটরসাইকেল যাতে ফুটপাতে না চলাচল করতে পারে, সে জন্য অনেক জায়গায় লোহার খুঁটি পুঁতে দেওয়া আছে। তবু আটকানো যাচ্ছে না মোটরসাইকেলের চালকদের। তীব্র হর্ন দিয়ে দুরন্ত গতিতে ফুটপাতের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলার দৃশ্য রাজধানীতে যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যেকোনো সভ্য দেশেই ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ফুটপাত পথচারীদের জন্য নয়। ফুটপাতে হকাররা ব্যবসা করে। যেখানে হকার নেই, সেখানে আছে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য। পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহারের সুযোগই পায় না। এ ছাড়া নগরীর অনেক ফুটপাত আবার ভাঙা, চলাচলের অনুপযোগী। তাই পথচারীরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়েই চলাচল করছেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায়, তার ৫৮ শতাংশই পথচারী। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালক ও আরোহীর মারা যাওয়ার বা পঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। রাজধানীতে এমন চিত্র আরো বেশি ভয়াবহ। রাজধানীর মোটরসাইকেল সংখ্যার সঠিক হিসাব না থাকলেও ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় নিবন্ধনহীন মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের চেয়ে দ্বিগুণ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ৪ লাখ ৩২ হাজার ৫১১টি। এর মধ্যে ২০১০ সাল পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ২১ হাজার ৮১টি। ২০১১ সালে ৩৪ হাজার ৭০৮টি। ২০১২ সালে ৩২ হাজার ৮১০টি। ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ৩৩১টি। ২০১৪ সালে ৩২ হাজার ৮৯৪টি। ২০১৫ সালে ৪৬ হাজার ৭৬৪টি এবং ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৯২৩টির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে।

রাজধানীর ফার্মগেট থেকে পান্থপথ, গুলিস্তান, পল্টন, মালিবাগ, মগবাজার ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, রামপুরা, মৌচাক, বাড্ডা, কুড়িল, গাবতলী, শ্যামলী থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত এলাকায় মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চালানোর চিত্র বেশি পরিমাণে লক্ষ করা যায়। দেখা গেছে, পুলিশের সামনেই দ্রুতগতিতে চলে যাচ্ছেন মোটরসাইকেলের চালকরা। তীব্র হর্ন দিয়ে দুরন্ত গতিতে ফুটপাতের ওপর দিয়েই চলাচল করছেন অনেক মোটরসাইকেলের চালক। সময় বাঁচাতে নিয়মের বাইরে চলাচল করছেন অনেকেই। সিগন্যালে দীর্ঘ সময়ও যখন ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা মেলে না, তখন তারা একটু এদিক-সেদিক দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যানজটের সময় ফুটপাত দিয়ে যত্রতত্র মোটরসাইকেল চলাচলের কারণে পথচারীরা প্রতিনিয়তই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ফুটপাতে নির্বিঘেœ মোটরসাইকেল চলাচলের বিষয়টির তদারকি মাঠপর্যায়ে নেই। বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের পাশাপাশি ফুটপাত দিয়ে পুলিশের মোটরসাইকেলও চলাচল করতে দেখা যায়। ফুটপাতে চলাচলকারীরা সময় স্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে ফুটপাত দিয়ে সধারণভাবেই চলাচল করে থাকে।

হাইকোর্টের নির্দেশ ছাড়াও পথচারীদের হাঁটার অধিকার সংরক্ষণে সিটি করপোরেশন, মোটরযান আইন এবং মহানগর পুলিশ অর্ডিন্যান্সে বিভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু এগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। এর ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনাও ঘটছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) হিসাবে দেখানো হয়েছে, ঢাকা শহরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর শিকার হয় ৮৬ শতাংশ পথচারী। পথচারীদের নির্বিঘেœ চলাচলের সুযোগ না থাকাই এর অন্যতম কারণ। পথচারীদের চলাচলের নানামুখী বাধার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় হাইকোর্টের আদেশের পরও ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল কমেনি। বিভিন্ন এলাকায় অবাধেই মোটরসাইকেলের আরোহীরা ফুটপাতে চলছেন। যেহেতু আইন সম্পর্কে মোটরসাইকেলের চালকদের ন্যূনতম ধারণা নেই, সেহেতু তাদের আইন ও শাস্তি সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। যারা আইন জেনেও আইন ভঙ্গ করে তাদের কঠোর শাস্তি দিলেই এই প্রবণতা কমে আসতে পারে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যান চলাচলের বিষয়টি দেখার জন্য ঢাকা মহানগরে ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। যাতে করে ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল করে পথচারীদের দুর্ভোগের সৃষ্টি না করে সেদিক খেয়াল রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist