রেজাউল করিম খান

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

খালেদা জিয়ার মামলা রায় ঘিরে যত কথা

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় আজ। রায় নিয়ে সারা দেশে নানা কথা হচ্ছে। কথা বলছেন রাজনীতিক, পেশাজীবী, শ্রমিক-কৃষক সবাই। অপরাধ প্রমাণিত হলে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও আইনজীবীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে জনমনেও উৎকণ্ঠা রয়েছে। রায় নিয়ে পুলিশও উদ্বিগ্ন। তারাও কয়েক দফা বৈঠক করেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ‘২০১৩ ও ১৪ সালে যে ধরনের নাশকতা পুলিশ কঠোর হস্তে প্রতিরোধ ও দমন করেছে। এবারও পুলিশ চুপ থাকবে না। জড়িতদের গ্রেফতার শুরু হয়েছে। এ পক্রিয়া চলবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বেগম জিয়ার মামলার রায় নিয়ে কোনো বিশৃঙ্খলা হলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে।

বিএনপি রায়টিকে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। তাদের ধারণা, মামলায় বেগম জিয়াকে সাজা দেওয়া হবে, যা সরকার আগেই নির্ধারণ করে রেখেছে। এই কারণে রায় পরবর্তী দল ও জোটের করণীয় সম্পর্কে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কর্মসূচি আসেনি। নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, রায়ে সাজা হলে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে। তবে সেই আন্দোলন কী ধরনের হবে, কে নেতৃত্ব দেবেন তা বলা হয়নি। বিএনপি নেতারা বলেন, এ ব্যাপারে ‘ম্যাডাম’ই সিদ্ধান্ত নেবেন। অদ্ভুত কথা! সাজা হওয়ার আগে বা পরে বেগম জিয়াকেই বলতে হবে, এখন কী করতে হবে। সংকটকালীন সময়ে দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান ছাড়া কেউই করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তবে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা ও কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই সভায় বেগম জিয়া বলেছেন, তারা গায়ের জোরে বিচার করতে চায়। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বহু ষড়যন্ত্র ও নানা রকমভাবে হয়রানি করা হবে। কিন্তু আমরা ভয়ে ভীত নই। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি।’ তার এই কথার রেশ বাতাসে না মেলাতেই সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার শুরু হয়েছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতোমধ্যে আট শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে।

৮ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে পুলিশ সারা দেশে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেকের বাড়িতেই তল্লাশি ও আটক করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন, নাশকতার পরিকল্পনা, গোপন বৈঠক অথবা আগের কোনো মামলায় তাদের পলাতক দেখানো হচ্ছে। এর ফলে নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের বাড়ি ছেড়ে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত সোমবার বেগম জিয়া সড়কপথে সিলেট গিয়েছিলেন। তাকে স্বগত জানাতে নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে জড়ো হচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাদের রাস্তার পাশে দাঁড়াতে দেয়নি। অনেককে গ্রেফতারও করে। এদিকে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজপথ দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত আবার আগুন-সন্ত্রাস করতে পারে। প্রত্যেক নেতাকর্মীকে সতর্ক থাকতে হবে। আগুন-সন্ত্রাসীদের রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজপথ দখলে নিতে হবে। এই মন্ত্রী কি মনে করেন রাজপথ এখন আওয়ামী লীগের দখলে নেই?

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় রায়ের দিন আওয়ামী লীগের কর্মসূচি না রাখতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সমাবেশে তিনি বলেন, বিএনপিকে নিয়ে কোনো অস্থিরতা নেই। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও বলেছেন, রায় নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু পুলিশের অতি তৎপরতায় এই কথায় আস্থা রাখতে পারছে না সাধারণ মানুষ। অবশ্য এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় রাখার কোনো কারণও নেই।

বেগম জিয়া আদালতে তার আত্মপক্ষ সমর্থনে রাখা বক্তব্যে বলেন, ‘দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ ১৯৭৯ সালে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ২০০৫ সালে তাকে অযোগ্য হিসেবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে আবার নিয়োগের দুই দিন পরই তাকে এই মামলা অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।’ বেগম জিয়া দাবি করেন, অবৈধ নিয়োগ হওয়ার ফলে তিনি আদালতে মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। রায়ে সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে ক্ষমতাসীনরা। এই মামলা মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এই মামলা দায়ের করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ৫ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত অভিযোগ গঠন করে। বেগম খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমান, সাবেক এমপি সালিমুল হক কামাল, শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী ও জিয়াউর রহমানের ভাগিনা মমিনুর রহমানকে আসামি করা হয়। আসামি কাজী সালিমুল হক ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ কারাগারে আছেন। কামালউদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ একটি প্রতিষ্ঠান। তার কাজ নির্ধারিত থাকে। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় পদের নাম গোপন করে বেগম খালেদা জিয়া নামসর্বস্ব জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন। কিন্তু অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ করে ট্রাস্টের কল্যাণে সরিষা পরিমাণ কাজ করেননি। ট্রাস্টের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সোনালী ব্যাংক শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়। সেই হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর পদ গোপন করেছেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার প্রধান আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান বলেন, ‘এটি একটি অসার মামলা। খালেদা জিয়া খালাস পাবেন। অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘আমরা অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করেছি। আমাদের বিশ্বাস, ছয় আসামির সবাই সর্বোচ্চ সাজা পাবে।’ ২৩৬ কার্যদিবস শুনানির পর মামলাটি রায়ের পর্যায়ে এসেছে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করবেন ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আখতারুজ্জামান। আইনজীবীরা বলছেন, এই মামলায় দ-বিধি ও দুদকের দুটি ধারা। দ-বিধির অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে। আর দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদ-। দ-বিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী ‘যে ব্যক্তি তার সরকারি কর্মচারীজনিত ক্ষমতার বা একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি বা প্রতিভূ হিসেবে তাহার ব্যবসায় বা দেশে যেকোনো ধরনের কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির ওপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদ-ে বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদ-ে দ-িত হইবে এবং তদুপরি অর্থদ-ে দ-িত হইবে।’ দুদক আইনের ৫(২) ধারায় বলা আছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী অপরাধমূলক অসদাচরণ করিলে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করিলে তিনি ৭ বৎসর পর্যন্ত কারাদ- অথবা জরিমানা অথবা উভয় দ-ের যোগ্য হইবেন।’ বেগম জিয়ার সাজা হলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি নাÑ তা নিয়েও আলোচনা চলছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, বেগম জিয়ার সাজা হলে উচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে। আপিল হলো কনটিনিউশন অব দ্য প্রসিডিংস। অর্থাৎ যে বিচার হয়েছে, এটা হলো সেই বিচারের ধারাবাহিকতা। তিনি জামিন পাবেন এবং নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। দলের নেতৃত্ব দিতেও কোনো বাধা থাকবে না।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায়ে সাজা অথবা খালাস যা-ই ঘোষণা করা হোক না কেন, তাতে বিএনপিরই লাভ হবে বলে কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। দেশবাসী আশা করছে, সবকিছু যেন শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist