ফয়জুন্নেসা মণি

  ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

কৃষ্টির প্রতীক কাকতাড়ুয়া

গ্রামবাংলায় প্রকৃতির মায়াঘেরা গ্রামীণ জীবনের মূর্ত এক প্রতীকের নাম কাকতাড়ুয়া। দূর থেকে দেখতে ঢোলাঢালা জোব্বা পরা, মুখে চুনকালি মাখা আর মাথায় কালো পাতিলের টুপি পরা কাকতাড়ুয়া এক পায়ে এক ঠাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না ভূত না মানুষ- দেখতে কিম্বাকৃতির অদ্ভুত প্রাণী। যা দেখে ভয় পায় পাখি ও ফসলি জমির শত্রু ইঁদুর মহাশয়রা। বাতাসে এর একটু-আধটু নড়াচড়া দেখলেই পাখিরা পালায়। রাতে তা দেখে ভয়ে গর্তে ঢোকে ইঁদুরের দল। এই হলো কাকতাড়–য়া। কাকতাড়–য়া বা ঝপধৎবপৎড়ি কৃষিপ্রধান আমাদের বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকার ফসল পাখিদের কবল থেকে রক্ষা করতে সর্বাধিক ব্যবহৃত সনাতন পদ্ধতি। নাম কাকতাড়–য়া হলেও ফসলি জমিতে ঝাঁপিয়ে পড়া পাখিদের তাড়াতে ব্যবহৃত এই অদ্ভুত বস্তুটির নামকরণ হলো কাকতাড়–য়া। এটি শুধু কাক তাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয় না।

আমাদের গ্রামবাংলায় কাকতাড়–য়ার সরল কিম্ভূত চেহারা প্রদর্শন করা হয়- খাড়া লম্বাকৃতি একটি দ-ের ওপরের এক-তৃতীয়াংশে ভূমি সমান্তরালে আড়াআড়িভাবে আরেকটি দ- বেঁধে দুপাশে হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো মানবাকৃতি তৈরি করা হয়। এই মানবাকৃতির গায়ে পড়ানো হয় পুরোনো ছেঁড়া জামা, গেঞ্জি বা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি বা প্যান্ট। লম্বাকৃতি দ-ের ওপরের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয় মাটির পাতিল। এরপর সজ্জিত মানবাকৃতির কাকতাড়–য়া পুঁতে রাখা হয় ফসলের জমির মাঝখানে। পাতিলকে মানুষের মাথা হিসেবে বোঝানো হয় এবং এতে কালো আর সাদা রং লাগিয়ে (চুনা পাউডার আর কয়লা) মানুষের চোখ, নাক, দাঁত এঁকে দেওয়া হয় ক্ষেত্রবিশেষে। হালকা লিকলিকে এমন মানবাকৃতির কাকতাড়–য়া সামান্য বাতাসে নড়েচড়ে আর তাই দেখে ফসলি জমিতে আধার নিতে আসা পাখিরা উড়াল মানুষ ভেবে ভয়ে উড়াল দেয়। সনাতনী পদ্ধতি হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল এই অভিনব চিরায়ত প্রতীক কাকতাড়–য়া পাখি আর ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষায় যুগে যুগে ভূমিকা রেখে আসছে। চাঁদনি রাতে এই কাকতাড়–য়ার নড়াচাড়ায় এর ছায়া এদিক-সেদিক প্রতিবিম্ব ছড়ায় আর তা দেখে ধান কাটতে আসা ইঁদুরেরা ভয়ে গর্তে পালায়। ভাবতে অবাক লাগে, প্রাণিজগতের জীবনধ্বংসী কিছু না করেও কী দারুণ অভিনব প্রাকৃতিক পদ্ধতির আবিষ্কার করেছেন গ্রামবাংলার প্রাচীন কৃষকরা। আর আধুনিক সভ্যতার একালে গুলির ঠুসঠাস, গুলালির আঘাত কিংবা বিষয় প্রয়োগে প্রাণিজগতের জীবন ধ্বংস করা হয় কত না অবলীলায়! তবে অনেক স্থানে ধর্মীয় কিংবা স্থানীয় বিশ্বাসের আচারের পরিপ্রেক্ষিতে পাতিলের তলায় গোল গোল বুটি অথবা চারকোনো ছক ইত্যাদি এঁকে মাটির সানকি দিয়ে ফসলের সু-উৎপাদন কামনা করা হয় বলেও বিভিন্ন এলাকা রীতি প্রচলিত আছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় কাকতাড়–য়ার ব্যবহার লক্ষণীয়। বিশেষত শীতকালে ধানখেত, সরষেখেত, ডালখেতসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে কাকতাড়–য়া কাক কিংবা অন্যান্য পশুপাখিকে ভয় দেখানোর জন্য জমিতে রক্ষিত মানুষের প্রতিকৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই কাকতাড়–য়া যে শুধু পাখি কিংবা ইঁদুরকে ভয় দেখা তা নয়। রাতের বেলায় হঠাৎ কাকতাড়–য়ার নড়াচড়া দেখে অনেক পথচারীকেই ভয়ে গা কাঁপিয়ে দেয়। কাকতাড়–য়া দেখে দেখে রাতে ভয়ে দৌড়ে বাড়ি পালিয়ে সকালে এসে আসল আদল দেখে বোকা সাজার বহু গল্প গ্রামে প্রচলিত। তবে শুধু পাকা ফসল নয়, শীতকালীন সবজি বা রবিশস্য চাষের সময় বীজ বপন বা চারা রোপণের বেশ কয়েক দিন পরেও বীজ বা চারার দানা মাটির সঙ্গে মিশতে পারে না। মূলত এই সময়টাই চারাগাছগুলোর সংকটকাল। এ সময় কাক, চড়ুই, শালিক, ঘুঘু ইত্যাদি বিভিন্ন পাখি এসে চারাগাছ উপড়িয়ে ফেলে। পাখিদের এই আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করতে জমিতে বীজ বপনের সঙ্গে সঙ্গে জমির মধ্য বরাবর কাকতাড়ুয়া দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। জমির শস্যরক্ষায় কৃষকের উদ্ভাবিত এই প্রাকৃতিক অবলম্বন কাকতাড়ুয়া শস্যখেত থেকে শুধু বীজ নষ্টকারী পাখিদেরই দূরে রাখে না, বাড়ন্ত শস্যখেতের দিকে পথচারীর লোভাতুর দৃষ্টিকেও মায়াজালে বন্দি করে এমনই বিশ্বাস সনাতনে বিশ্বসী কৃষককুলের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কাকতাড়–য়া ব্যবহারের সুফল পেয়ে কৃষকরাও মহাখুশি। রাতের বেলায় ইঁদুর যখন খেতের শস্য কেটে গর্তে ঢোকাতে যায়, তখন এই কাকতাড়–য়া দেখে তারা ভয় পায়। তারা ভাবে মানুষ বা কিছু একটা তাদের পাহারা দিচ্ছে। দিনের বেলায় পাখিরা এই অদ্ভুত জিনিসটি দেখতে পেয়ে সেই জমিতে আর নামতে সাহস পায় না। এমন বিশ্বাস থেকে গ্রামের কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে কাকতাড়–য়ার ব্যবহার শুরু হয় সেই প্রাচীনকাল থেকে। কৃষকের সৃষ্টিশীলতার মুগ্ধতায় এই অভিনব আবিষ্কার কাকতাড়–য়া কেবল ফসলের জমিতে নয়Ñকাকতাড়–য়া উঠে এসেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের তালিকায়। মজার ব্যাপার হলোÑকালের প্রবাহে ফসল রক্ষার এই সনাতনী পদ্ধতিটি গ্রামবাংলার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠে আসে গল্প, কবিতা, নাটক ও সিনেমায়। এরপর কাকতাড়–য়া আধুনিক সমাজে পৌঁছে যায় শিল্পীর চিত্রকর্মে বইয়ের প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে।

তবে বলতে দ্বিধা নেই, কাকতাড়–য়া কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সৃজনী ঐতিহ্য হয়ে থাকবে কালে কালে। গ্রামের কৃষক খেতের ফসলকে পাখি আর ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করার কৌশল হিসেবে এমন অদ্ভুত ও অভিনব পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। গ্রামবাংলার ফসলের খেতের অতি পরিচিত দৃশ্য এই কাকতাড়–য়া। লম্বা খাড়া দ-ায়মান একটি খুঁটি এবং দুই বা তিন ফুট ওপরে আড়াআড়ি আরেকটি খুঁটি বেঁধে তাতে ছন বা খড় পেঁচিয়ে মোটাসোটা করা হয়। তারপর আড়াআড়ি বাঁধানো অংশের সামান্য ওপরে ছন বা খড়কুটো দিয়ে ডিম্বাকৃতি বা মাথার মতো বস্তু বানানো হয়। এরপর বাড়ি থেকে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত ছেঁড়া জামা বা পাঞ্জাবি পরিয়ে দেওয়া হয় এটিকে। ডিম্বাকৃতির অংশটিকে ঢেকে দেওয়া হয় মাটির হাঁড়ি দিয়ে। সেই হাঁড়িতে চোখ-নাক-মুখ এঁকে দেওয়া হয় চুন বা চক দিয়ে। ফলে এক অদ্ভুত অভিনব সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, যা দেখে ভয় পাওয়ার মতো একটা ব্যাপার ঘটে। এই কাকতাড়–য়াকে ফসলি জমির মাঝখানে দ-ায়মান পুঁতে রাখা হয়। অনেকের বিশ্বাস কাকতাড়–য়া বাড়ন্ত ফসলের দিকে পথচারীর কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। অনেক সময় কাকদের ভয় দেখার জন্য অন্য একটি কাক মেরে উঁচুতে ঝুলিয়েও রাখা হয়। সাধারণত ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে কাকতাড়ুয়ার জন্ম।

কাকতাড়–য়া নিয়ে বিছু মিথ প্রচলিত আছে। যেমন যে পথ দিয়ে দিনের বেলা হেঁটে যেতে কিছু দেখেননি, রাতের আঁধারে বাড়ির ফেরার সময় যদি দেখেন সেখানে কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে। হাত নাড়াচাড়া করে ডাকছেÑব্যাপারটা তবে কেমন হতে পারে বুঝতেই পারছেন। এমন অনেক কাহিনি শোনা গেছে, কাকতাড়–য়া দেখে জায়গায় ফিট খেয়েছেন কেউ কেউ। কেউবা ভয়ে দৌড়ে বাড়ি গেছেন। পরে অবশ্য দিনে আলোয় সবার ভুল ভেঙেছে। যাহোক, গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে কাকতাড়–য়া হাজার বছর বেঁচে থাকুক আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে।

লেখক : শিক্ষক, কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist