মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২১ জানুয়ারি, ২০১৮

মতামত

সভ্যতার ধারকবাহক

একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। শিক্ষকদের ভূমিকার স্বীকৃতিস্মারক হিসেবে গত ১৯ জানুয়ারি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’টি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারকবাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও।

সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের অবস্থানের যে পরিবর্তন হয়েছে তা অকল্পনীয়, অভাবনীয়। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের ঈদ বোনাস, উৎসব ভাতাসহ শতভাগ জাতীয় পে-স্কেলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এত সুবিধার পরও একজন শিক্ষকের অমনোযোগিতা ও যোগ্যতার অভাবে শিক্ষাদানের কার্যটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। শিক্ষকদের ভুলে গেলে চলবে না, তারা জনগণের টাকায় গড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এখন তারা কর্মজীবী হিসেবে জনগণের টাকায় মাসিক বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। তাই এখন শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করতে হবে। তার পরেও বলতে হয়, সরকারি চাকরির সঙ্গে মানমর্যাদার অনেক ক্ষেত্রে এখনো অসামাঞ্জস্য ও অসম বৈষম্য রয়েছে। স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের আজও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।

শিক্ষকতার পেশায় নৈতিকতা খুবই জরুরি। নীতিনৈতিকতাবোধ জাগ্রত না হলে কারো পক্ষে এ মহান পেশায় থাকা ঠিক নয়। শিক্ষকরাই জাতির মেরুদ-। কথাটি যথার্থ, সময়োপযোগী ও ন্যায়সংগত মনে হলেও প্রশ্ন থাকে কোন শিক্ষক? অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হবেÑছাত্রদের যেকোনো সমস্যায় ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা। কথায় ও কাজে, পোশাক ও রুচিতে, পেশায় ও কর্তব্য পালনে শিক্ষক হবেন আদর্শবান, ধর্মপ্রাণ, সত্যপ্রিয় অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। শিক্ষক হবেন রোল মডেল বা আদর্শ, জ্ঞানের উৎস, আনন্দের ভা-ার। অর্থাৎ একজন শিক্ষক হবেন চতুর্মুখী প্রতিভার অধিকারী। তাই তাকে হতে হবে আর দশটি মানুষের তুলনায় সেরা।

সহশিক্ষার সুযোগে ক্লাসমেট এমনকি পিতৃতুল্য কতিপয় শিক্ষক নামধারী পরিমল মার্কা নরপশু ছাত্রীদের ধোঁকাবাজি ও গুপ্ত প্রেম-ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে দৈহিক সুখ লুটার সুযোগে থাকে। শিক্ষক-শিক্ষিকা বাবা-মায়ের সমান। বাবা ও মায়ের পরেই যে ব্যক্তিটি শিশু-কিশোরদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন তিনি হলেন শিক্ষক। অথচ সেই শিক্ষকনামধারী কতিপয় লম্পট, চরিত্রহীন, নরপশু দ্বারাই আজ বিভিন্নভাবে নিগৃহ হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক হেলাল প্রাইভেট পড়ানোর কৌশলে ছাত্রীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে ছবি তোলা ও পরে ওই ছবি দেখিয়ে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে যৌন নির্যাতন চালানো। পান্না মাস্টার যিনি দেড় শ ছাত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে ভিডিও করেছে বছরের পর বছর ধরে।

পরিতাপের বিষয়, আজ শিক্ষাদানকে সেবা নয় বাণিজ্য হিসেবেই দেখছে অনেকে। তাই এ দেশে শিক্ষার মানের উন্নতি না হয়ে হচ্ছে অবনতি। এখন প্লে শ্রেণিতে পড়া একটি বাচ্চাকেও গৃহশিক্ষক দিতে হয়। ছোট-বড় সব ক্লাসের নোট/গাইডে বাজার সয়লাব। বাছাই করে দেওয়া গাইডের প্রশ্নই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে হুবহু তুলে দেন শিক্ষকরা। জানা যায়, প্রতিটি নোট/গাইডের প্রকাশকরা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছরই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে থাকে। এই ধরনের অনৈতিক শিক্ষকতার ফল কখনো সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না; যা ঘটার তাই ঘটছে। অন্তঃসারশূন্য জাতি গঠিত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা মূল বইনির্ভর না হয়ে গৃহশিক্ষক ও গাইডনির্ভর হয়ে পড়ছে।

আগে তো শিক্ষা এতটা বাণিজ্যিক ছিল না, শিক্ষকরা এত নীতিভ্রষ্ট ছিলেন না। তারাও অর্থকষ্টে ভুগতেন, তাই বলে কখনো অর্থলোভী হতেন না। গড়ি-বাড়ির স্বপ্নও তারা দেখতেন না। সততা, সরলতা ও সবকিছুতেই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে চলতেন, তারা ছিলেন আদর্শ ও নীতিনৈতিকতার মূর্তপ্রতীক। তাদের পায়ে জুতা ছিল না; খালি পায়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে তারা স্কুলে আসতেন। সব সুবিধা নাই এর মধ্য থেকেও ছাত্রদের আকর্ষণ ছিল শুধু শিক্ষকদের প্রচ- ব্যক্তিত্ব ও ভালোবাসা। তাদের মধ্যে ছিল আবেগমিশ্রিত কথাবার্তা, শিক্ষায় উৎসাহ, উদ্দীপনা, একাগ্রতা, শেখানোর দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রত্যাশা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-শিক্ষকদের মননে আজ জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে অর্থার্জনই বড়। সাধনা, জ্ঞানচর্চা, শিক্ষাদান সবই এখন অপমৃয়মান। ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোর প্রতি অনেক শিক্ষকের আগ্রহ বেশি। অনেকে সরাসরি বলতে পারেন না। এ জন্য পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম দেন, অকারণে শিক্ষার্থীদের প্রতি বিরূপ আচরণ করেন। অনেকে আবার সরাসরি বলেও ফেলেন। ক্লাসে ঠিকমতো না বুঝিয়ে প্রাইভেটে বোঝানÑএমন শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয়। প্রাইভেট পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ছাত্র সংগ্রহ করতে স্কুলে আসা, এমন মনোভাব যাতে শিক্ষকদের মধ্যে গড়ে না ওঠে সে জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist