সিলেট প্রতিনিধি

  ২৩ জুন, ২০২২

সিলেটে দুর্গত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার

স্বামী-সন্তান নিয়ে কোনো মতে বেঁচে গেলেও পেটের জ্বালায় কাতর গৃহবধূ শায়লা খাতুন। ঠাঁই হয়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কে। শায়লা বলেন, ‘এখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও পেটের জ্বালায় ভুগছি। ছয় দিন ধরে দিনে মাত্র একবেলা চিড়া-মুড়ি খেয়ে বেঁচে আছি। বিশুদ্ধ পানির বদলে বানের জলে তৃষ্ণা মেটাচ্ছি। শুকনো খেয়ে আর পারছি না। বাচ্চারা ভাতের জন্য হাইমাউ করে কাঁদে। এখন পর্যন্ত কেউ একথালা খিচুড়িও দেয়নি।’

একই আশ্রয়কেন্দ্রে স্ত্রীকে নিয়ে উঠেছেন বৃদ্ধ তছির আলী। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। শরীরে ভাসা বেঁধেছে নানা রোগ। হাঁটাচলা করতে পারেন না। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ইলা ফানি (বন্যা) আর দেখছি না। আমার সবতা নিছে গি, কুন্তা রইছে না। পেটও খুব বুক (ক্ষুধা) লাগে, চিড়া-মুড়িয়ে পেট ভরে না। ভাই খাইয়া অইভ্যাস। আমারে ভাত দেও।’

শুধু শায়লা-তছির আলী নন। তাদের মতো অনেক দুর্গত জানান, গতকাল দুপুর পর্যন্ত তাদের কাছে সরকারি ত্রাণ পৌঁছায়নি। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন এবং ব্যক্তি-উদ্যোগে এখানে চিড়া, মুড়ি, গুড়সহ বিভিন্ন শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে।

গতকাল বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে দেখা যায়, সবচেয়ে দুর্বিপাকে আছে শিশু ও বয়স্ক নারীরা। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীরা আছেন নানামুখী সংকটে। তবে এসব কেন্দ্রে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত কারো কাছে কোনো চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছায়নি। মৌলিক বিষয়ে এখনই নজর না দিলে মানবিক সংকটও আরো গভীর হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে জকিগঞ্জ উপজেলা : পৌরসভাসহ ৯টি ইউনিয়নের সব এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফয়সাল বলেন, তিন দিন ধরেই অল্প অল্প করে পানি বাড়ছে। গতকাল সারা দিন রোদ থাকলেও ঢলের কারণে পানি বেড়েছে। উপজেলার ৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২০১টি পরিবারের ৮২১ জন আশ্রয় নিয়েছে। আমরা ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছি।

অন্যদিকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বন্যা আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। অনেক জায়গায় ত্রাণ সাহায্যের অপ্রতুলতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওসমানীনগর উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত রয়েছে। ত্রাণ সহায়তা পেতেও বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের অবস্থা অপরিবর্তিত : সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। শহরের একটি অংশের কিছু স্থানে সামান্য বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ জেলা প্রশাসন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। আমরা ৪৫০ আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ স্যালাইন দিচ্ছি।’

অন্যদিকে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, হবিগঞ্জের ছয়টি উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। জেলার ১৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ১৩ হাজার ২৮৯টি পরিবার। সরকারিভাবে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৫।

কুশিয়ারা নদীর তাণ্ডবে ডুবছে মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে। এতে শেরপুর এলাকা, খলিলপুর, মনুমুখ, আখাইলকুড়া ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। দুর্গতরা আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়ি বা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় উঠেছে।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১০১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে নারী, পুরুষ ও শিশু মিলে ২৪ হাজার। মেডিকেল টিমের ৬০ জন মাঠে নিয়োজিত। জেলার সাতটি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা চার লাখ। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার। ১ হাজার ৩০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘যোগাযোগ বিড়ম্বনা কমে আসছে, নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে। এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, খাবার পৌঁছানো এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ।’

নিখোঁজের তিন দিন পর ভেসে উঠল লাশ : এদিকে জৈন্তাপুরে নিখোঁজের তিন দিনের মাথায় নদীতে ভেসে উঠল নিখোঁজ যুবকের লাশ। গতকাল বেলা ১১টায় স্থানীয় নৌকাশ্রমিকরা সারী নদীর কামরাঙ্গী স্কুলঘাট এলাকায় একটি লাশ ভেসে থাকতে দেখে বিষয়টি স্থানীয়দের জানান। নিহতের নাম বিলাল। সে চারিকাট ইউপির দক্ষিণ কামরাঙ্গীখেল গ্রামের মুহিব মিয়ার ছেলে। এলাকাবাসী জানায়, গত রবিবার রাত থেকে দক্ষিণ কামরাঙ্গীখেল গ্রামের বিলাল আহমদ (৪০) নিখোঁজ হন।

ফের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা : কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় বন্যার পানি বাড়ছে। তাতে এখন গতি কমিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে পানি বাড়লে বা স্রোত বাড়লে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রাখা যাবে কি না তা আশঙ্কা রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। সারা দেশের সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী এই তিন উপজেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।

ভারতের বরাক নদী সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জের আমলশীদে এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বরাকের বেশির ভাগ পানি প্রবাহিত হয় কুশিয়ারা দিয়ে। উৎসমুখে নাব্যতা সংকটে বাধা পেয়ে সুরমা নদী দিয়ে বরাকের পানি কম প্রবাহিত হচ্ছে। শুধু তাণ্ডই নয়, প্রতি বছর বন্যায় সুরমায় দেখা দেয় ভয়াবহ ভাঙন। সেই তুলনায় কুশিয়ারার ভাঙনের রেকর্ড কম।

সুরমার ডাইক ভেঙে পানি লোকালয়ে এবং নগরে ঢুকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বৃষ্টিপাত কিছুটা কমতে শুরু হওয়ায় এবার শান্ত হওয়ার পথে সুরমা। তবে উত্তাল রূপ ধারণ করেছে কুশিয়ারা। গত তিন দিন থেকে কুশিয়ারার তাণ্ডবে পানির নিচে সিলেটের বিস্তীর্ণ এলাকা। সুরমা-কুশিয়ারার অন্তত ১৫টি স্থানে দুই নদীর ডাইক ভেঙে প্রবল বেগে জকিগঞ্জের ৯টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারার ভয়াবহতা ছেয়ে গেছে জেলার বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও ওসমানীনগর এবং মৌলভীবাজারে।

এদিকে গত মঙ্গলবার মাঝরাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সিলেটে ভারী বর্ষণ হয়েছে। নগরের তালতলা, মির্জাজাঙ্গাল, লামাবাজার, কুয়ারপাড়, লালাদীঘির পাড়, শিবগঞ্জ, তেররতন, শাহজালাল উপশহর এলাকায় পানি আগের অবস্থানে রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close