কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২১ নভেম্বর, ২০১৮

বেকায়দায় শাসক দলের এমপিরা

আ.লীগের কোন্দলের ফায়দা নিতে পারে বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের আসনগুলোতে আওয়ামী লীগে আছেন একাধিক শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত দলের নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে ইঙ্গিত মিলেছে, চট্টগ্রামে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে না। প্রায় সব আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন বর্তমান এমপিরা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা চলছে। অনেক আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বর্তমানে জাতীয় পার্টির দুই প্রভাবশালী এমপি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুর অবস্থাও সন্তোষজনক। তাদের এবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মেনে নেবে কি না সংশয় রয়েছে।

এরই মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে দলীয় অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে সংসদ সদস্যদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই পরিবর্তন চেয়ে বর্তমান সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী বেশ কয়েকজন নেতা। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা ভাগ হয়ে পড়েছেন। যার ফায়দা নিতে চাইবে প্রতিপক্ষ বিএনপি। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির মধ্যে তেমন একটা কোন্দল নেই বললেই চলে। দল যাকেই মনোনয়ন দিক তার পক্ষে লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনে মরিয়া বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। মঙ্গলবার ঢাকায় বিএনপি কার্যালয়ে দলটির চট্টগ্রামের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার হয়। সে সময় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা কড়া নির্দেশ দেন, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় যেন কোনো কোন্দল না হয়। চট্টগ্রামের প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে তারা সম্মিলিতভাবে কাজ করবেন।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুস সত্তার বলেন, অন্য দলের কোন্দল নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা নেই। তবে বিএনপিতে কোন্দল নেই, নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। সুষ্ঠু ভোট হলে আমাদের জয় সুনিশ্চিত। তবে তফসিল ঘোষণার পরও বিএনপি নেতাকর্মীদের পুলিশি হয়রানি বন্ধ হয়নি। এ কারণে নির্বাচনী পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হচ্ছে। আওয়ামী লীগ দলীয় একাধিক সূত্র মতে, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যদের জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলুকে সরিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে বসানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে। প্রতিটি আসনে কোন্দল, প্রার্থী জট দুশ্চিন্তায় ফেলেছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের। যার কারণে চট্টগ্রামের বাকি আসনগুলোতে প্রার্থী পরিবর্তন করতে চাচ্ছে না দলটি। এরপরও চলছে শেষ মুহূর্তের সমীকরণ মেলানোর কাজ। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে কোন্দল, বিদ্রোহী ঠেকাতে দলের পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তির বার্তা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগে নতুন মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার অর্থ, আগের মনোনয়নপ্রাপ্ত তথা বর্তমান সংসদ সদস্যদের প্রতি অনাস্থা। টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য দলের ভেতর থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হিসেবে যারা জয়ী হয়েছেন, তাদেরও কারো কারো বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ক্ষোভ-অসন্তোষ রয়েছে।

চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তারই মনোনয়ন পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এই আসনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী মিরসরাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দিন ও চট্টগ্রাম জুনিয়র চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ এলিট।

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনের সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। তিনি তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান। সংগঠনটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। ফলে কেন্দ্রে ভান্ডারীর যথেষ্ট প্রভাব আছে। কিন্তু নিজ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ তার বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম এবং জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক খাদিজাতুল আনোয়ার বেশি সোচ্চার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও আওয়ামী লীগকে কীভাবে তিনি সামাল দেবেন তা নিয়ে এলাকায় এখন আলোচনা চলছে। জানতে চাইলে এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে হেরে যান তিনি (সংসদ সদস্য ভান্ডারী)। তখন জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের সংগঠিত করেছিলেন। এখন সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে রাজনীতি করছেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, আমার বিরোধিতাকারীরা এমপি পদে মনোনয়ন পেতে মিথ্যা অভিযোগগুলো করছে।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকু-) আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য দিদারুল আলম। এবারও তিনি দলের মনোনয়ন পেতে পারেন। এ আসনে মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে বর্তমানে সীতাকু- উপজেলা চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সভাপতি এস এম আল মামুন এবং সীতাকু- উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া।

চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী-বায়েজিদ) আসনে এবার আওয়ামী লীগ কোনো অবস্থাতেই জাতীয় পার্টির এমপি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলামকে মেনে নেবে না বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বার বার আওয়ামী লীগের কাঁধে চড়ে এমপি হওয়া ব্যারিস্টার আনিস হাটহাজারীর উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি এ অভিযোগ অহরহ। আসনটিতে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এবার প্রার্থী হতে চাইছেন। আসনটিতে যে কোন্দল রয়েছে তাতে ফায়দা নেবে বিএনপি।

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী) সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য জাসদের মইনউদ্দিন খান বাদলকে এবার মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে চান না স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তার বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার একই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী। তবে শেষ পর্যন্ত বাদলই এই আসনে মহাজোটের প্রার্থী থাকছেন বলে ইঙ্গিত মিলছে। এমনটি হলে কর্মী বিহীন জাসদের বাদলকে জিতিয়ে আনতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীরা মাঠে নামবেন কি না সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী-হালিশহর) আসনটিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক মন্ত্রী আফছারুল আমিন। এরই মধ্যে আসনটির জন্য লবিং এ নেমেছেন সাবেক মেয়র মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। তিনি বিএনপির হয়ে মেয়র হয়েছেন। পরবর্তিতে বিএনপি ছেড়ে পুরনো আওয়ামী লীগে চলে আসেন। ফলে এ আসন ঘিরেও চলছে নানা নাটক। এ সুযোগে বিএনপি ফায়দা লুটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ লতিফকে ফের প্রার্থী করতে পারে আওয়ামী লীগ। তবে এই আসনে প্রার্থী হতে মরিয়া মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। নগর আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে লতিফের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। অন্যদিকে ৪৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তৃণমূলে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা সুজন মনোনয়নবঞ্চিত হলে তার প্রভাব ভোটে পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। এক সময় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে এই দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মীর বিরোধ রয়েছে। এই আসনে প্রার্থী হতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন। শেষ পর্যন্ত আমিনকে ডিঙিয়ে নদভী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলে ভোটের মাঠে তার প্রভাব পড়তে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close