মাসুদ অর্ণব

  ২৯ আগস্ট, ২০২২

আমাদের জনজীবনে বর্ষা ও বন্যার প্রভাব

ফাইল ছবি।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হলেও আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীবনযাপনে বর্ষার প্রভাব অতুলনীয়। তাই বর্ষা অনেকেরই প্রিয় ঋতু। প্রকৃতি ও মানুষের জীবনঘনিষ্ঠতায় একটি দেশের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কেননা, প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্য মানুষের মনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে বর্ষা ঋতু আমাদের মনকে সহজ-সরল ও সৃষ্টিশীল করে তোলে। শুধু তা-ই না, অর্থনৈতিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বিস্তারের পাশাপাশি বর্ষা বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বর্ষার কারণেই আমাদের বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠেছে।

আষাঢ়-শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল হলেও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই বাংলাদেশে বর্ষার পদচারণা শুরু হয়ে যায। তখন শুধু আমাদের বাইরের আকাশটাই নয়, আমাদের মনের আকাশটাকেও নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে যায়। সজল-শ্যামল বর্ষার সঙ্গে আছে বাঙালির প্রাণের সুনিবিড় সম্পর্ক। বৃষ্টি আর বর্ষা মানেই মাটির উর্বরতা বেড়ে যাওয়া, ফসল বোনার সময় হওয়া আর নদীতে মাছের আনাগোনা বাড়তে থাকা। সারা বছর বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে যায় অনেক নদী, খাল-বিল ও হাওর। বর্ষা এলে সেখানে প্রাণ ফিরে আসে। প্রকৃতি ফিরে পায় সজীবতা।

প্রায় সারা বছরের খাদ্য উৎপাদনের ফলে অর্থনৈতিক জীবনে বর্ষার অবদান অসামান্য। মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদটির সত্যতাও পাওয়া যায় বর্ষা ঋতুতে। মাঠে কাদা জলের খেলা, অবিরাম বর্ষণ, বজ্রপাত ও ঝড়-বন্যার ভয়াল রূপ তুচ্ছ করে বাংলাদেশের অবহেলিত কৃষক সম্প্রদায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে এ সময় মাঠে মাঠে বীজ বোনে, চারাগাছ তোলে, চারাগাছ রোপণ করে। সারা বছরের অন্নবস্ত্র, আর্থিক সচ্ছলতা সবকিছুই নির্ভর করে বর্ষার প্রসন্নতা ও দাক্ষিণ্যের ওপর। অতিবর্ষণের ফলে বর্ষা তার স্বাভাবিক রূপের পরিবর্তে ধারণ করে ভয়াবহ সর্বগ্রাসী রূপ। তখন বহু গ্রাম জনপদ ধ্বংস হয়, বহু প্রাণহানি ঘটে, খেতের ফসল এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। তবু প্রতি বছর বর্ষার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে বাংলার কৃষকসহ আপামর মানুষ। কেননা, বর্ষা বাংলার জীবনসাধনা ও ভাব-সাধনার অনন্য রূপকার।

বাংলাদেশে যে বিখ্যাত মসলিন কাপড় বোনা হতো, তা বড় নৌকায় করে বিশ্বের নানা প্রান্তে নেওয়া হতো। বর্ষায় নদীর পানি বেড়ে গেলে বিশাল বিশাল নৌকা আসত ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে। সেগুলোতে করে পূর্ব এশিয়া থেকে মসলা আর হরেক রকমের শৌখিন পণ্য আসত। আর আমাদের থেকে নিয়ে যেত মসলিন। বছরের অন্য সময়ে নদীতে পানি কম থাকায় এত বড় নৌকা আসতে পারত না তখন। তাই কৃষি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই ছিল বর্ষানির্ভর। বর্ষায় বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙা হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি উপকরণ বিভিন্ন মৌসুমি ফল। এ সময় পাওয়া যায় পেয়ারা, লটকন, আমড়া, জাম্বুরা, জামরুল, ডেউয়া, কামরাঙা, কাউ, গাব ইত্যাদি বিভিন্ন স্বাদের ফল। অর্থ উপার্জনের জন্য অনেক মৌসুমি ফলচাষি এসব ফলের বাগান করে থাকেন। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পিরোজপুর ও ঝালকাঠির পেয়ারা আবাদ হয় এই বর্ষায়। বর্ষা ঋতুই অগ্রণী ভূমিকা রাখে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে।

সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য সবক্ষেত্রে পরিমিতবোধ অবশ্যই কাম্য। তাই, অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি কোনোটাই কাম্য না। উভয়টা জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। অনাবৃষ্টিতে বৃষ্টির প্রার্থনায় রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনা। সময়টা পনেরো শতকের মাঝামাঝি। ভারতবর্ষের সম্রাট আকবরের দরবারে মিয়া তানসেন নামে একজন শিল্পী ছিলেন। কথিত আছে, তার সংগীতের সুরের ছন্দে বৃষ্টিহীন আকাশে মেঘ জমত, শুরু হতো অঝোরধারায় বৃষ্টি। হিন্দুধর্মে তো বৃষ্টির একজন দেবতাও আছেন, যার নাম ইন্দ্র। শুধু যে ভারতবর্ষেই বৃষ্টি নিয়ে এত মাতামাতি, তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর সব প্রাচীন সভ্যতা আর ধর্মে বৃষ্টিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হতো। কারণ, মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছে বৃষ্টি আর নদীকে কেন্দ্র করে। মানুষ বৃষ্টিবহুল আর নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসতি গড়েছে সব সময়। পৃথিবীর অধিকাংশ বড় শহর ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে প্রকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানকে কেন্দ্র করে। এ কারণে লাতিন আমেরিকার মায়া সভ্যতার অন্যতম দেবতা ‘চাক’ ইন্দ্রের মতোই বৃষ্টি নিয়ে আসতেন। একইভাবে চীনাদের দেবতা ইউ শি থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপের প্রাচীন অধিবাসীদের বৃষ্টি আর উর্বরতার দেবী ছিলেন লোনো। আমাদের দেশেও বৃষ্টির জন্য মসজিদ-মন্দিরে প্রার্থনা ও পূজাপার্বন হয়ে থাকে, ব্যাঙের বিয়ের মতো ঘটনাও ঘটে।

বর্ষা আমাদের জীবনে মায়ের মতো হলেও বন্যা যেন সৎ মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণ যেমন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য, তেমনি প্রতি বছর বন্যাকবলিত হওয়াও আরো একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে। ভৌগোলিক ও অন্যান্য কারণে বন্যার সুতীব্র প্রভাব আমাদের জনজীবনে। উৎসের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বন্যাকে চার ভাগে ভাগ করা যায় : ক. আকস্মিক বন্যা, খ. অতিবৃষ্টিজনিত বন্যা, গ. ঘূর্ণিঝড়জনিত বন্যা এবং ঘ. মৌসুমি বন্যা। এ চার প্রকার বন্যা দেশের চারটি অঞ্চলে দেখা যায়। আকস্মিক বন্যা হয় পাহাড়ি অঞ্চলে, বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা হয় নিম্নাঞ্চলে, ঘূর্ণিঝড়জনিত বন্যা উপকূলীয় অঞ্চলে এবং মৌসুমি বন্যা হয় দেশের সমগ্র সমভূমিতে।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এ দেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা স্বাভাবিক বন্যায় প্লাবিত হয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রায় এক ডজন ভয়াবহ বন্যা এ দেশের ৩৫,০০০-৫৫,০০০ বর্গ কিমি এলাকা মারাত্মকভাবে প্লাবিত করেছে। এতে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭০ সালের মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে শুধু লোকই মারা যায় সরকারি হিসাবে ৫ লাখ। ১৯৮৮ সালের বন্যা রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ৯৮,৩৩৩ বর্গ কিমি (সমগ্র দেশের দুই-তৃতীয়াংশ) এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাজনিত কারণে এ দেশে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক আট শ কোটি টাকা। ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬৪টি জেলার ৫৩টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর পরও বাংলাদেশে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে বহুবার। বিশেষ করে ১৯৯৮, ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে প্রায় বাংলাদেশ জুড়ে বড় বন্যা হয়েছে। তাই, বর্ষা এলেই আমরা বন্যাতঙ্কিত থাকি।

বাংলাদেশ অবস্থানগতভাবেই বন্যাপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী মেঘনা, যমুনা ও পদ্মা সবগুলোরই উৎপত্তিস্থল ভারত। মূলত এ তিন নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণের হ্রাস বৃদ্ধির ওপরই বাংলাদেশের বন্যা নির্ভরশীল। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও হিমালয়ের বরফগলা পানির আধিক্য বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের ভূমির উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালুর পরিমাণ বেশি নয় এবং বাংলাদেশ গড়ে সমুদ্রতটের তুলনায় মাত্র ৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, তাই এখানকার নদীগুলাের পলিবহন ক্ষমতা খুবই কম। ফলে প্রতি বছর নদীবক্ষে পলি জমাট হয়ে নদীর গভীরতা কমে যায়। ক্রমবর্ধমান মানুষ সব নিচু জায়গা ভরাট করে তাতে তৈরি করেছে শহর, নগর ও নতুন নতুন ঘরবাড়ি। ফলে পানিপ্রবাহের অনেক পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই প্রকৃতিও এর প্রতিশোধ নিচ্ছে বন্যার সৃষ্টি করে। যাকে আমরা বলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

কম-বেশি বন্যা সিলেটাঞ্চলের জন্যও একটি সাধারণ ঘটনা। যদিও এ বছর অসাধারণ ঘটনা গঠেছে সিলেটে। বাংলাদেশ আবহাওয়া দপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, সিলেট জেলায় বিগত ১০০ বছরেও এত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যায়নি। সুরমা-কুশিয়ারা-কালনীর উৎসও ভারতে। আমাদের উচিত ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমাঝোতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদী হিসাবে এর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ এবং পাহাড়ের ঢালে জলাধারা সৃষ্টির মাধ্যমে অতিরিক্ত জল আটকে রেখে বন্যার প্রবণতা হ্রাস করা। নদীর ওপর কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না, যাতে নদীর বৈরী আচরণ ও নদী খাতে পলল সঞ্চয়নের মাধ্যমে ভরাট হয়ে অতিরিক্ত পানি বহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। তা ছাড়া, সুরমা-কুশিয়ারা-কালনী নদী আঁকা-বাঁকা ও সর্পিল প্রকৃতির হওয়ায় নদীবাহিত পানি নদীর বাঁকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নদী পাড় ছাপিয়ে সমভূমিতে প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে।

বর্ষা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হলেও অতিবন্যা অবশ্যই অভিশাপস্বরূপ। কেননা, বন্যার ভয়াবহতা এ দেশের মানুষের জান-মালের ক্ষতির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই, নদীর বুকে জেগে ওঠা চরসমূহ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করে নদীর জল নিষ্কাশনে পরিকল্পিত অবস্থা সৃষ্টি করা জরুরি। কাজেই নীতিনির্ধারকদের উচিত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে বন্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখা।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের জনজীবন,বর্ষা ও বন্যার প্রভাব
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close