হীরেন পণ্ডিত

  ২১ জুলাই, ২০২২

সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতেই হবে

এসডিজির অভীষ্ট ৩:৬-এ বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা ২০২০ সালের মধ্যে অর্ধেকে কমিয়ে নিয়ে আসা। এসডিজির অভীষ্ট ১১:২-এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সুলভ পরিবহন ব্যবস্থায় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রাই কিন্তু আমরা অর্জন করতে পারিনি, অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলে। আমরা দুর্ঘটনা কমাতে পারিনি! বরং বাড়ছে।

গত রমজানের ঈদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এবার ঈদুল আজহায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। গত ঈদে ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে ১২ লাখ ট্রিপ হলেও এবার চলেছে এক লাখ ২০ হাজার মোটরসাইকেল। ঈদ এবং এর আগে ও পরে পাঁচ দিনে ২৩ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ জনের বেশি। নিহত ৫১ জনের মধ্যে মোটরসাইকেল-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়। রাজধানী ঢাকাসহ আরো ১০ জেলায় গত কয়েক দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন। কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

চলতি বছরের শুরু থেকে গত ১২ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে গাবতলী-পাটুরিয়া মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০টি। এর মধ্যে ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে শুধু একটি পরিবহন। একটি পরিবহন এত দুর্ঘটনায় কেন? কারণ দীর্ঘদিন ব্যবহারে ফিটনেস হারানোয় বাসগুলোর দূরপাল্লায় চলাচলের সক্ষমতা নেই। বেশির ভাগ বাসের এই পথে চলাচলের অনুমোদন নেই। সেই সঙ্গে বেশির ভাগ চালকের লাইসেন্সও নেই।

আমরা কোনোভাবেই এমন অনিরাপদ সড়ক চাই না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা সড়ককে নিপাপদ হিসেবে দেখতে চাই। চালকদের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। গাড়ির ফিটনেসের ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে এপ্রিল মাসে দেশে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৭ জন নারী ও ৮১ জন শিশুসহ ৫৪৩ জন নিহত ও ৬১২ জন আহত হয়েছেন। ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৬ জন, যা নিহতের ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

একটি পরিবারের কর্মক্ষম মানুষ যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন বা প্রতিবন্ধী হয়ে যান তখন সেই পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পতিত হয়ে নিদারুণ কষ্ট হয়ে যায় নিত্যসঙ্গী। এ রকম হাজারো পরিবার সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সড়ক দুর্ঘটনা দেশের উন্নয়নে সব সময় নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয় বরং সড়ককে নিরাপদ করতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সড়ক ব্যবস্থাপনার সার্বিক উন্নয়নসহ আইন প্রয়োগে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার সর্বোচ্চ ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১১৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা নিহতের ২১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৮৭ জন, যা নিহতের ১৬ শতাংশ। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র মোটরসাইকেলে সবচেয়ে বেশি। মোটরসাইকেলের সহজলভ্যতার জন্য অনেকটা দায়ী। তা ছাড়া মোটরসাইকেল চালকদের হেলমেট না পরা, ট্রাফিক আইন না মেনে দুজনের অধিক মোটরসাইকেলে আরোহণ করা, মোটরসাইকেলের চালকদের বেপরোয়া মনোভাব সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিলকে দীর্ঘায়িত করছে।

বিশ্বের অন্য কোনো দেশ এভাবে মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য করেনি। গণপরিবহনকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বিকল্প হিসেবে মোটরসাইকেলের বিক্রি ও ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কে যাত্রী নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যাবে কি না তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে মোটরসাইকেল চালাতে আইনসম্মতভাবে হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী। এপ্রিলে সড়কে প্রাণ ঝরেছে ৬৩ জন শিক্ষার্থীর। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতা ১২ জন, ব্যবসায়ী ৩১, শিক্ষক ১৩, পুলিশ সদস্য চার, সেনা সদস্য এক, র‌্যাব সদস্য এক, বিজিবি সদস্য এক, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য দুজন, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য এক, চিকিৎসক দুজন, সাংবাদিক তিন, আইনজীবী চার, প্রকৌশলী দুই, সংগীতশিল্পী এক, ব্যাংক কর্মকর্তা ৯, এনজিও কর্মকর্তা ১১, ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ১৯, পোশাকশ্রমিক সাত, চালকল শ্রমিক দুই, ইটভাটা শ্রমিক চার, ধানকাটা শ্রমিক ছয় ও মাটিকাটা শ্রমিক চারজন।

সচরাচর যেসব কারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ে তার মধ্যে অন্যতম হলো ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, যানবাহনের বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার কারণে সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে এ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানকে প্রধান করে ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত ২২ সদস্যের কমিটি ২০১৯ সালে ১১১টি সুপারিশ তৈরি করেছে। এর মধ্যে ৫৪ নম্বর সুপারিশে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। গঠন করা হয়েছিল টাস্কফোর্স। ২০১৮ সালে, গত বছরের শেষের দিকে ও চলতি বছরের শুরুতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। ওই সময় তাদের ৯টি দাবির মধ্যে একটি ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এত প্রাণহানি, আন্দোলন, দফায় দফায় বৈঠক, সুপারিশ, টাস্কফোর্স গঠনের পরও প্রতিনিয়ত কেন সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলছে? এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কেন? সমস্যাটা কোথায়?

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নিরাপদ সড়ক চাই, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ও যাত্রীকল্যাণ সমিতির সবাই একই কথা বলছেন। বলছেন, যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদ, বাস ও ট্রাকের আয়ুষ্কাল নির্ধারণসহ অনুপযুক্ত গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সড়কের চেয়ে পরিবহনের সংখ্যা বেশি। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছেই। আবার যত পরিবহন রয়েছে, সে অনুযায়ী প্রশিক্ষিত চালক নেই। পরিবহন সেক্টরে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন আসেনি। ফলে পরিবহন সেক্টরও যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায়ই রয়ে গেছে। যানবাহন ও সড়ক-মহাসড়কের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তুলনামূলক কাজের গতি। মনিটরিং ব্যবস্থা ও এনালগ যুগের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার এই অবস্থায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত ৬ দফা নির্দেশনামা দ্রুত বাস্তবায়ন করা, টাস্কফোর্স দাখিল করা ১১১টি সুপারিশনামা যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার প্রধানতম কারণ চালকের অদক্ষতা ও প্রতিযোগিতাপ্রবণ মনোভাব, সুতরাং সর্বাগ্রে চালকের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান প্রদান নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধ ও ধৈর্যের শিক্ষাও দিতে হবে। সতর্কতা ও সচেতনতার অভাব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির অন্যতম কারণ হওয়ায় পথচারী, যাত্রী, চালক সবাইকে সচেতন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সবাই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে পথচারী ও যাত্রীদের অধিক সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। তারা সচেতন হলে দুর্ঘটনা প্রায় অর্ধেক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, আইন আছে কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ বাস্তব ক্ষেত্রে তেমন নেই। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো বন্ধ করা সম্ভব হয়নি এত দিনেও। আইনের প্রয়োগই যদি না হয়, তবে আইন করা আর না করা একই কথা। যদিও বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সড়ক,শৃঙ্খলা,ফেরাতে হবে
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close