অলোক আচার্য, গণমাধ্যমকর্মী

  ২২ জুলাই, ২০১৯

আমার বর্ষা, দুরন্তপনার শৈশব এবং নষ্টালজিয়া

বাংলায় ঋতুরাজ বসন্ত হলেও বর্ষার গ্রহণযোগ্যতা ও বর্ষার প্রতি ভালোবাসা অপরিসীম। বৃষ্টির মাতাল করা ছন্দ মাতিয়ে রাখে বাংলার মানুষকে। খুব ছেলেবেলা থেকেই আমি বর্ষা প্রিয়। বলা যায় আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি কবে জ্যৈষ্ঠের শেষ হবে। তাহলেই যে আষাঢ়ের শুরু! আষাঢ় মানেই বৃষ্টি, আষাঢ় মানেই বর্ষা! আমার মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। আমি জানি আষাঢ়ের প্রথম দিনেই বৃষ্টি হবে। এ এক গভীর বিশ্বাস। তবে সব বর্ষাতেই যে এমন হয়েছে তা নয়। একবারের কথা বলি- আমি আমার কর্মস্থলে কাজ করছি। আষাঢ়ের প্রথম দিন। অথচ দুপুর পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টি আসেনি। আমার মনটা ছটফট করছে। আমার এক সহকর্মীকে জিজ্ঞ্যেস করলাম, আজ তবে কি বৃষ্টি হবে না? নিতান্তই বোকার মতো প্রশ্ন। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, হওয়ার তো কথা। এই কথা বলার আধ ঘণ্টার মধ্যে আকাশ কালো হয়ে গেলো। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। আমি বারান্দায় এসে বৃষ্টির জল ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। এই হলো আমার অবস্থা। আমার কাটানো প্রতিটি বর্ষায় মিশে আছে আবেগ ও প্রগাঢ় অনুভূতি। আমরা ছুটে বেড়িয়েছি মাঠ-ঘাট, নদী-নালায়। বর্ষা এলেই মুষলধারে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যেতো মাঠ-ঘাট। আশেপাশের পুকুর ডোবায় দিন-রাত অবিশ্রান্ত ব্যাঙের ডাক। বৃষ্টি এলেই আমরা দুষ্টু ছেলের দল বাড়ির পাশের মাঠে দৌড় দিতাম। তারপর মটকা (অনেক উঁচু ভবন থেকে তীব্র বেগে পরা জল) থেকে গড়িয়ে পরা জলের নিচে মাথা দেয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যেতো।

বড় হওয়ার সাথে সাথে বর্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে লাগলো। এক সময় যে বর্ষা আমার দুরন্তপনার স্বাক্ষী ছিল, বড় হওয়ার সাথে সাথে তার সাথে মিশে যায় আবেগ, ভালোবাসার অনুভূতি। কোনো এক গভীর শূন্যতায় ভরে থাকতো সেসময়। গ্রামের অধিকাংশ ঘরই তখন টিনের তৈরি। ফলে বৃষ্টির সাথে সাথে এক তরঙ্গের ঢেউ ওঠে। ঘরের বিছানায় শুয়ে সে নূপুরের ছন্দ আমি প্রতিদিন শুনেছি। আজও বৃষ্টি এলে আমি কান পেতে সেই মধুর শব্দ শুনি। প্রকৃতির নিজ হাতে তোলা সে সুরে যেন মাদকতা মেশানো থাকে। তবে আজকাল গ্রামেও আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে। টিনের চালের পরিবর্তে পাকা দালান উঠেছে। ফলে সেই শব্দ আজ শুনতে পাওয়া যায় কমই। আমার কাছে ইট কাঠ ঘেরা শহরে হওয়া বৃষ্টি আর গ্রামের শ্যাওলা ভরা এঁদো পুকুরে হওয়া বৃষ্টির সৌন্দর্যে পার্থক্য রয়েছে। শহরের বৃষ্টিতেও যেন প্রাণ নেই। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ধরা আমার চিরকালের অভ্যাস। বৃষ্টি এলে আজও আমি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেই। বৃষ্টি ধরি, বৃষ্টির জল ছুয়ে দেখতে আজও বড় ইচ্ছে করে আমার। বড় হয়েও যেন সেই ছোট বেলার বৃষ্টিটাকে মন থেকে বড় করতে পারিনি। ছোট বেলায় বৃষ্টি এলে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিতাম। কোনোটি বৃষ্টি জলে মুখ থুবড়ে পরতো আবার কোনোটা ঠিক পথ খুঁজে নিত। বড় হয়ে বৃষ্টি এলে দাবার সেট নিয়ে বসে যাই। গান ছেড়ে শুনতে থাকি। মনটা উদাস হয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। কাউকে খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে। সে এক অদ্ভূত অনুভূতি! কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এরকম এক ভরা বর্ষায় জোৎস্না ভরা রাতে নৌকায় চড়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সবার নেই। আমরা বহুদিন চাঁদের মিষ্টি আলোতে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। এই রুপালি সময় মনে দু চার লাইন কবিতা আসেনি তা নয়। মাথার ওপর পূর্ণিমার চাঁদ, মাঝির বৈঠার সাথে জলের শব্দ আর চারদিকে জোনাকির মেলা। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! এত সব বর্ষায় কাটানো সময়গুলো মনে পরলে বড় নষ্টালজিক হয়ে যাই।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বর্ষা,দুরন্তপনা,শৈশব,নষ্টালজিয়া
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close