এস আর শানু খান

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

১১৮ বছর বয়সী স্কুলের গল্প

গংগারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয় দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে সে ভূমিকা নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছে । দক্ষিনাঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশে যে কয়টি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, গংগারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম ।

নবগঙ্গা নদীর ঠিক পশ্চিম কূল ঘেষেই মাগুরা জেলার শালিখা থানাধীন গংগারামপুর বাজার। তার লাগা পশ্চিমেই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বীয় ঐতিহ্যকে মাথায় করে আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবমণ্ডিত বিদ্যাপীঠ গংগারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যার রয়েছে ১১৭ বছরের মত অধিক সময়ের স্বরণীয় ও সুদীর্ঘ এক ইতিহাস।

বিদ্যালয়ে আনন্দমূলক পরিবেশে শিক্ষাদানের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীর প্রতিভা বিকশিত করার ব্যাপারে শ্রেণি শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। একজন শিক্ষকের ওপরই বিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। বিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষার একজন সুনিপুন মিস্ত্রি, যিনি গঠন করবেন ছাত্র-ছাত্রীর মানবাত্মা। তিনি জাতি গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ কারিগর। একজন শিক্ষকই পারেন ছাত্র-ছাত্রীর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করতে। যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা অসম্ভব। শিক্ষককে হতে হবে আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তার থাকতে হবে চরম ধৈর্য্য ও ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষার প্রতি আগ্রহী। ছাত্র-ছাত্রীর অবুঝ মন বুঝার ক্ষমতা থাকতে হবে শিক্ষকে। একজন শিক্ষককে হতে হবে ছাত্র-ছাত্রী মনো বিজ্ঞানী। শিক্ষক একাধারে হবেন, শিক্ষাগুরু, পিতা-মাতা ও নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। যে ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষককে ভয় পাবে সে ছাত্র-ছাত্রী শিখতে আগ্রহী হবে না। কোনও ছাত্র যদি শিক্ষককে ভয় পায় তা হলে সে শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষা দানে অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়াই স্বাভাবিক।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদকে গংগারামপুর প্রসন্ন কুমার উচ্চ বিদ্যালয়টি যশোহর জেলার মাগুরা মহাকুমার অর্ন্তগত শালিখা থানার অধীন ৭ নং গংগারামপুর ইউনিয়নের গংগারামপুর গ্রামে অবস্থিত। তৎকালীন কালিয়া নিবাসী এবং মাগুরার খ্যাতনামা উকিল কামিনী কুমার সেন গুপ্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইংরেজি ১৯০০ সালে অত্র বিদ্যালয়টির প্রথম জীবন লাভ ঘটে। তার পিতৃব্য যশোরের প্রখ্যাত উকিল প্রসন্ন কুমার সেন গুপ্তের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়, ”গংগারামপুর প্রসন্ন কুমার উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়।“

১৯০৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অস্থায়ী মঞ্জুর লাভ করে। এরপর থেকেই স্কুলের শ্রীবৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় পরমেশ্বরপুর নিবাসী বিদ্যানুরাগী শ্রীযুক্ত বাবু সীতানাথ মুখ্যোপাধ্যায় তার সক্রিয় কর্মচিন্তা নিয়ে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্র্ণ হন এবং স্কুলের নতুন রুপদানে ব্রতী হন। তারই অদম্য উৎসাহে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের প্রথম কোঠাঘর নির্মাণের জন্য স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী সুধীবৃন্দের সহযোগীতায় বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন স্থান হতে অর্থ সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। অবশেষে স্কুলের কোঠা ঘরের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। পরবর্তীতে এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন সময় স্কুলের বিভিন্ন শিক্ষকদের নিরলস পরিশ্রমে সময়ের বিবর্তনে স্কুলটি আজ নিজের অবস্থানটি একদম পাকপোস্ত করে নিয়েছে। মাগুরা জেলা তথা যশোর বোর্ডের বিদ্যালয় তালিকায় প্রথম দিকের একটা নাম হলো গংগারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

স্কুলের যাত্রাটা প্রথমে সহজ না হলেও পরবর্তীতে নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে নিজের চলার পথকে সহজ ও গতিশীল করে নিয়েছে এই বিদ্যাপীঠ। বছরের পর বছর হাজার হাজার মানুষের ভিতরকার অন্ধকার কাটিয়ে শিক্ষার তীক্ষ্ণ আলো ছড়িয়ে আসছে এই বিদ্যালয়টি। এই স্কুলের বহু ছাত্র দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন। বর্তমানে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার ২০০। এর মধ্যে ছাত্র ৮০০, ছাত্রী ৪০০। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৪০।

শুরুতে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।। তখন শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১৫ জন। মাত্র ৮০-১০০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এর নানাবিধ প্রতিকূলতা ও শত বাধাবিপত্তিকে তোয়াক্কা না করে আপন মহিমায় উজ্জীবিত হতে থাকে গংগারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যুগের পর যুগ হাজারো উজ্জল নক্ষত্রের জননী এই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেশ বিদেশের বড় বড় স্থানে জায়গা করে নিয়েছে। এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে সচিব হয়েছেন শাহাদাত ইসলাম। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. স্বদেশ চক্রবর্তী এই স্কুলেরই ছাত্র। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে আছেন শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী আশরাফ হোসেন। দেশের সারা জাগানো উপস্থাপক, সাংবাদিক মুন্নি সাহার স্বামী তাপস বোসও এই স্কুলেরই ছাত্র। এভাবে এই স্কুল থেকে যাওয়া অসংখ্য শিক্ষার্থী দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। ১৯৮৩ সালে এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে সুইডেনে পাড়ি জমান রহমান মৃধা। তিনি এখন সুইডেনের একজন বিখ্যাত কেমিস্ট ও ব্যবসায়ী। এছাড়াও আরও দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নানা দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন এ বিদ্যাপীঠের অগণিত ছাত্র ছাত্রী। এই বিদ্যালয়ের এমন একজন শিক্ষার্থী যিনি এখন বর্তমানে দেশের স্বনামধণ্য একজন ইঞ্জিনিয়র। ইঞ্জিনিয়র মোঃ কামাল হোসেন। তিনি এই মায়াময়ী মহৎ বিদ্যাপীঠের শত বর্ষের হাজার হাজার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রদের একটা শিকড়ে বাধার মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন। ১৯০০ সালের পর থেকে এই বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি বীজের সাথে প্রতিটি বীজের রয়েছে এক আত্মার সম্পর্ক। রয়েছে এক নাড়ির টান। যে বীজ অঙ্কুরিত হোক বা না হোক, সেই কুড়ি ফুটুক বা না ফুটক, ফুল ফোটার আগেই ঝড়ে পড়া সকলেই এই বিদ্যালয়ের কাছে চির ঋনী। তারা সকলেই এই মায়ের সন্তান।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
১১৮ বছর,স্কুলের গল্প
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close