আহমদ আবদুল্লাহ

  ০১ ডিসেম্বর, ২০১৮

ধুলু মিয়ার শ্বশুরবাড়ি

ছোট্ট স্টেশন। নাম রহিতনগর। লোকাল ট্রেন ছাড়া অন্য কোনো ট্রেন থামে না সেখানে। সকাল ১১টায় যে ট্রেন আসে, সেটা ফিরে যায় সন্ধ্যায়। আবার রাত ১০টায় ওই একই লোকাল দশমিনা থেকে ছেড়ে যায় বর্ধমান অভিমুখে। রহিতনগর স্টেশনেও থেমে যায় কিছুক্ষণ।

রাতের ট্রেনে ভিড় থাকে না যাত্রীদের। যাত্রীরা বেশ শুয়ে বসে আরামের সঙ্গেই যার যার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। তবে নির্ধারিত সময়েই যে ট্রেন পৌঁছাবে, এমন কথা জোর গলায় বলতে পারে না রেল কর্তৃপক্ষও।

ধুলু মিয়া যখন রহিতনগর স্টেশনে নামল, তখন ঘণ্টার কাটা ১১টা ছুঁই ছুঁই। তার হাতে বেশ বড় আকারের এক ব্যাগ, পরিচ্ছন্ন বেশ-বাস। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চারপাশ তাকাল একবার। কিন্তু তার দিকে এগিয়ে এলো না কেউ। ধুলু মিয়া অবশ্য চিঠিতে লিখেছিল, ২৫ তারিখ দুপুরে ঢাকা থেকে রওনা হব। রাত ১০টায় রহিতনগর পৌঁছাবে বলে আশা রাখি। কেউ যেন স্টেশনে উপস্থিত থাকে।

দেখতে দেখতে জনশূন্য হয়ে গেল স্টেশন। ধুলু মিয়ার মনের মধ্যে নানা রকম চিন্তা জন্মালো। ট্রেন একঘণ্টা লেট। তবে কি কেউ এসে ফিরে গেল? তাই বা হবে কেন? ট্রেন লেট করলে সেও লেট করবে। না কি আবার চিঠি পায়নি! ভাবতে ভাবতে চায়ের দোকানে গিয়ে বসল ধুলু মিয়া। তারপর চা খেতে খেতে দোকানের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখান থেকে কুন্দগ্রাম কত দূর হবে?’ ছেলেটি বলল, ‘কত দূর আর হবে, এক মাইলের একটু বেশি হতে পারে। তো কুন্দগ্রাম কার বাড়িতে যাবেন?’

-গাজী বাড়ি।

-গাজী বাড়ি তো একটা না। আপনি নাম বলেন।

-মাসউদ গাজীর বাড়ি যাব।

-মাসউদ গাজী আপনার কি হয়?

-শ্বশুর।

-ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, বুঝতে পারছি। আপনি আলতাফের দুলাভাই। কিন্তু হাতে আপনার মিষ্টি কই? শ্বশুরবাড়ি কি মিষ্টি ছাড়া যায়? পাশের দোকানে টাটকা রসগোল্লা আছে, নিয়ে যান। ছেলেটার কথায় ধুলু মিয়া একটু লজ্জা পেল। সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তাটাও খানিকটা কমে গেল। তার মনে হলো শ্বশুরবাড়ি বুঝি এসেই গেছি। সেও মনে মনে হাসলো।

-আসলে আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। তাছাড়া এর আগে তো আর বিয়ে করিনি, সবকিছু জানিও না।

-তাহলে শুনুন, আপনি যখনই শ্বশুরবাড়ি যাবেন তখনই মিষ্টি আর পান-সুপারি সঙ্গে নেবেন। আমাদের এলাকায় এটাই নিয়ম।

-বেশ তো। কিন্তু এখন কি আর ওসব পাওয়া যাবে? তার চেয়ে বরং পাশের দোকান থেকে মিষ্টিই নিয়ে যাই। দুই কেজি হবে তো?

ধুলু মিয়া মাত্র একবারই কুন্দগ্রাম গেছে। সেও প্রায় তিন মাস আগে। বাড়ি থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে জোর করে বড় চাচা তাকে রহিতনগর নিয়ে যায় মেয়ে দেখাতে। মেয়ে দেখার পর ওই রাতেই বিয়ে হয় ধুলু মিয়ার। সাদামাটা বিয়ে। লোকজন বা বাদ্য-বাজনা কোনোটাই ছিল না। কথা ছিল, পরে এসে দিনক্ষণ ঠিক করে বৌ নিয়ে যাবে বাড়িতে। রাতটা শেষ না হতেই ধুলু মিয়া রওনা দিয়েছিল ঢাকার পথে। ছোট চাকরি কিন্তু অনেক দায়িত্ব তার। ফলে আর আসা হয়নি। ধুলু মিয়া সেসব কথা এখন না তুলে বলল, এখান থেকে কুন্দগ্রাম যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে কি? ছেলেটা বলল, ‘স্টেশনের ওপাশে ভ্যান বা রিকশা পাবেন। আর না পাইলেও ক্ষতি নেই। এই গ্রামের পর ছোট্ট একটা মাঠ। মাঠের ওপাশেই কুন্দগ্রাম। জোছনা রাত, ভয়ের কিছু নেই।

কথায় কথায় রাত বাড়ে। ধুলু মিয়া ভাবলো, পথঘাট, বাড়িঘরের কথা স্পষ্ট খেয়াল নেই। ছেলেটাকে কি সঙ্গে যেতে বলব। কিন্তু কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। এমনেতেই নানা ঝামেলায় বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে কবেই। শেষে তার মনে হলো রিকশাওয়ালা তো সব চেনে। সেই পৌঁছে দেবে। এক হাতে ভারী ব্যাগ, অন্যহাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে পা বাড়াল ধুলু মিয়া। পেছন থেকে ছেলেটি চিৎকার করে বলল, দুলাভাই ফেরার সময় চা খেয়ে যাবেন কিন্তু।

স্টেশন থেকে নেমে রিকশা বা ভ্যান কিছুই পাওয়া গেল না। পিচঢালা পথ চলে গেছে গ্রামের ভেতর। সে আর কিছু না ভেবে হাঁটতে শুরু করল। ধুলু মিয়া অনেকটা পথ হাঁটার পর হঠাৎ পেছনে থেকে হুড়পাড় শব্দে একটি ভ্যান আসতে দেখে থমকে দাঁড়াল। ভ্যানটা কাছে আসতেই চালককে ডেকে থামাল। বলল, আমাকে একটু কুন্দগ্রামে নিয়ে চলো তো ভাই। ছেলেটি বলল, ‘এখন আর ভাড়া টানব না। তাছাড়া আমি কুন্দগ্রামের দিকে যাব না। আমি বাঁয়ে যাব। তয়, মাঠ পর্যন্ত যাওয়ার পারেন। ধুলু মিয়া আর কিছু না বলে ওঠে বসলেন ভ্যানে। মাঠের সামনে এসে ভ্যান চলে গেল অন্য পথে। সে আবার হাঁটতে শুরু করল। মাঠের ভেতরের রাস্তাটা অবশ্য কাঁচা। তবে উঁচু আর দুই পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা পুল দেখল সামনে। এই পুলটার কথাই ধুলু মিয়া মনে মনে ভাবছিল এতক্ষণ। পুলটা পার হতেই অনেক পায়ের শব্দ এলো কানে। পেছনে ফিরে দেখল তিন-চারটা ছেলেমেয়ে দৌড়ে আসছে। যাক এতক্ষণে সাথী পাওয়া গেল। এরা নিশ্চয়ই কুন্দগ্রামের দিকেই যাবে। হয়তো নিকটাত্মীয় হতে পারে।

কথাটা ভাবতেই থেমে গেল ধুলু মিয়া। ছেলেমেয়েরা হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে বলল, ‘দুলাভাই! কোন ফাঁকে চলে আইলেন? গাড়ি লেট দেইখা আমরা গেলাম আকালী ফুপুর বাড়ি। এর ভেতর গাড়ি আইলো আবার চলেও গেলো। দ্যান, মিষ্টির হাঁড়িটা দ্যান।’ ধুলু মিয়া যা ভেবেছিল ঠিক তাই। একেবারেই কাছের লোক। খুশিতে কি যে বলবে ভেবে পায় না। শেষে বলল, ‘তোমরা কি আমাকে নেয়ার জন্য এসেছো? আমি ভাবলাম, আমার চিঠি বুঝি পাওনি তোমরা।’ দলের মধ্যে বড় মেয়েটা নাকের ডগায় আঙুল ঘষে বলল, ‘চিঠি পাবো না ক্যান? বুবু তো বিকাল থাইকাই পথ চাইয়া বইসে আছে।’ কথাটা শুনে ধুলু মিয়ার ঠোঁট গড়িয়ে হাসি ঝরলো। কথার পিঠে সে আর কিছুই বলতে পারল না আনন্দে।

এদিকে শালা-শালিরা পেছন থেকে টপটপ হাঁড়ির রসগোল্লা খেতে শুরু করে দিয়েছে। চপচপ শব্দ শুনে পেছনের দিকে তাকালো ধুলু মিয়া। কা- দেখে বলল, ‘একি করছো তোমরা! বাড়িতে গিয়ে যতো পারো খেয়ো। সঙ্গে সঙ্গে চারজন মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করে হাত চাটতে লাগল। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। ঠিক যেন ভূতের কান্না। একজন লম্বা হয়ে হাঁড়িটা উঁচু করে ধরে রেখেছে। মেয়েটিও লম্বা হয়ে জোর গলায় বলল, মিষ্টি দে। আরেকজন ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর। এত খাই খাই করিস নে। খাওয়ার সময় কি শেষ? ধুলু মিয়া তাদের কথা শুনে হাসল, কিন্তু পেছনে তাকাল না।

তখন রাত প্রায় দুটা। ধুলু মিয়া বলল, আর কতদূর? সে প্রশ্নের উত্তর দিল না কেউ। তারা তখন মিষ্টি কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত। এদিকে তাদের কাড়াকাড়িতে হাঁড়ি ভেঙে রাস্তায় পড়ে একাকার। ধুলু মিয়া আসল কা- বুঝে ভয়ে চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ। পরদিন সকালে এক লোক ভাঙা মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল মাঠে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছে কেউ একজন। ভয়ে আতঙ্কে পথচারীও চিৎকার। আশপাশের লোক সবাই দৌড়ে এলো। পাশেই পড়ে আছে বড় ব্যাগ আর মিষ্টির হাঁড়ি। এদিকে কানে কানে খবর ছড়িয়ে গেল পুরো কুন্দগ্রামে।

সকাল ৮টায় মাসুদ গাজীর কানেও পৌঁছাল খবরটা। মাসুদ গাজী খুব দুঃখ প্রকাশ করল। এরই মধ্যে এলো পিয়ন। মাসুদ গাজীর হাতে চিঠি দিয়ে বলল, গাজী সাহেব! চিঠিটা গতকাল দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু অসুস্থ থাকায় দিতে পারিনি, তাই আজকে দিলাম। পিয়ন চলে গেল। মনে মনে রাগ হতে লাগল মাসুদ গাজীর। সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলল চিঠিটা। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, এত ধুলু মিয়ার চিঠি। চিঠিটা পড়তেই তার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। পঁচিশ তারিখে তার কুন্দগ্রামে আসার কথা। আজ ছাব্বিশ তারিখ। অচেনা লোকটা তার জামাই ধুলু মিয়া ছাড়া আর কেউই না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। খবর শুনে আন্দর মহলে শুরু হয়ে গেল কান্নাকাটি। বাড়িসুদ্ধ লোক ছুটল সেই ভাঙা মন্দিরের সামনে।

মাসুদ গাজী জঙ্গলের কাছে আসতেই একটা ছেলে বলল, ‘দাদা! লোকটা শাহিদা ফুফুর জামাই। একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে। সবাই ধরাধরি করে ধুলু মিয়াকে নিয়ে গেল শ্বশুরবাড়ি। মাসুদ গাজী ডাক্তার কবিরাজ নিয়ে এলো। ধীরে ধীরে ধুলু মিয়া সুস্থ হয়ে উঠল। সুস্থ হয়েই ধুলু মিয়া বলল, ‘আমার চিঠি আপনারা পাননি?’ মাসুদ গাজী বলল, ‘বাবা! সবই কপাল। তোমার চিঠি পেলাম আজ সকালে। বেআক্কেল পিয়নটা যদি গতকালই চিঠিটা পৌঁছাতো, তা হলে...

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close