আবদুস সালাম
রানির মুকুট
এক দেশে কুঞ্জবন নামে বড় একটি রাজ্য ছিল। রাজ্যটির একপাশ দিয়ে একটি সুন্দর নদী বয়ে গেছে। কুঞ্জবনের রানি প্রায়ই ওই নদীতে প্রমোদভ্রমণে বের হতেন। রানির সফরসঙ্গী হিসেবে থাকতেন দু-একজন মন্ত্রী। নৌকার মাঝি নগেন বাবু রানির খুব বিশ্বস্ত ছিল। একদিন রানি প্রমোদভ্রমণ করে ফিরছিলেন। তীরে পৌঁছানোর একটু আগেই রানির মাথা থেকে মুকুটটি পানিতে পড়ে যায়। মাঝি পানিতে নেমে মুকুটটি অনেক খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু কোথাও পেল না। মূল্যবান মুকুটটি হারিয়ে রানি হতাশ হয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন।
রাতেরবেলায় নাগেন মাঝি তার স্ত্রী জয়ন্তীর সঙ্গে মুকুট হারানোর বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করল। ওই মুকুটটি ছিল খুবই দামি। হীরা ও মণি-মুক্তায়খচিত। মুকুটটি যদি কোনো রকমে খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে কোনো চিন্তার অবকাশ নেই। ভাগ্যের পরিবর্তন হতে আর দেরি হবে না। তাই মাঝি মুকুটটি খোঁজার জন্য মনে মনে একটা পরিকল্পনা করল। পরের দিন ভোরবেলায় নগেন মাঝি ঘুম থেকে উঠে একটি জাল নিয়ে নদীর উদ্দেশে রওনা দিল। নদীতে পৌঁছে মুকুটটি খোঁজাখুঁজি করল। কিছুক্ষণ পর সেই মুকুটটি তার জালে আটকে গেল। মাঝি খুব আশ্চর্যন্বিত হলো! সেটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেল। একটি পাথরও খোয়া যায়নি। সে গোপনে মুকুটটি বাড়িতে নিয়ে এলো। সেটি দেখে মাঝির বৌ জয়ন্তীও খুব খুশি হলো। তারা মুকুটটি নিয়ে রাজ্যের বাইরে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারা এমন একটা জায়গায় যাবে যেখানে তাদের কেউ চিনবে না। সেখানে তারা নতুন রাজ্য স্থাপন করবে। সেই রাজ্যে নগেন মাঝির বৌ হবে রানি আর সে হবে প্রধানমন্ত্রী।
নগেন মাঝি সপরিবারে খুব গোপনে কুঞ্জবন রাজ্য ছেড়ে চলে গেল। তারা প্রথমে নদীপথে কয়েক দিন ধরে যাত্রা করল। তারপর মাসাধিককাল হাঁটার পর অচিনপুর নামে একটি অজপাড়াগাঁয়ে উপস্থিত হলো। তারা সেখানে ঘর বাঁধল। তারা খোঁজখবর নিয়ে দেখল, গ্রামের বেশির ভাগ লোকজন ছিল মূর্খ। ওই গ্রামে অতীতে কোনো রাজা-রানি বা তাদের কোনো প্রতিনিধি পদার্পণ করেছে কি না, তা কেউই সঠিক করে বলতে পারল না। অচিনপুরের সঙ্গে অন্যান্য জনপদেরও কোনো যোগাযোগ ছিল না। গ্রামবাসীর মধ্যে দু-একজন কুঞ্জবন রাজ্যের নাম শুললেও তারা কখনো সেখানে যায়নি। কিংবা কীভাবে সেখানে যাওয়া যায় তাও তারা জানত না। তাই নগেন মাঝি অচিনপুরকেই তার স্বপ্নের রাজ্য হিসেবে বেছে নিল। তার বিশ্বাসÑতাদের সঙ্গে থাকা মূল্যবান মুকুট আর কিছু রাজপোশাক তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সাহায্য করবে। কীভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে হয় সেই অভিজ্ঞতা মাঝির ছিল। তাই স্বামী-স্ত্রী ঘরের মধ্যে কিছুদিন ধরে রাজ্য পরিচালনার অনুশীলন করতে থাকল।
এদিকে অন্য একদিন প্রমোদভ্রমণের জন্য রানি মনস্থ করলেন। এক প্রহরীকে দিয়ে নগেন মাঝিকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু প্রহরী কোথাও নগেন মাঝিকে খুঁজে পেল না। সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, মাসাধিককাল আগে নগেন মাঝি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে কুঞ্জবন রাজ্য ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। কেন তারা রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে, তার কারণ কী, কেউই তা বলতে পারল না। অবশেষে সুবল নামে এক মাঝির সাহায্যে রানি প্রমোদভ্রমণে বের হলেন।
নগেন মাঝি বেশ কিছুদিন ধরে অচিনপুর গ্রামের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখল। সে গ্রামবাসীকে বলল, অচিনপুরসহ আশপাশের এলাকা শাসন করার জন্য কুঞ্জবনের রানি আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। তার রাজ্যের দক্ষ এক মন্ত্রীকে অচিনপুরের রানি হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আমার স্ত্রী। তার নাম জয়ন্তী। নতুন রানি আগামী মাসের পহেলা তারিখ থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। অভিষেক অনুষ্ঠানে নতুন রানি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। নগেন মাঝির কথামতো গ্রামবাসী নির্ধারিত দিনে নতুন রানির বাড়িতে উপস্থিত হলো। নতুন রানি মুকুট পরে সবার সামনে উপস্থিত হলো। রানি তার নিজের পরিচয় দিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করল। তিনি অচিনপুর গ্রামকে নতুন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। রাজ্য পরিচালনার জন্য তিনি সবার সাহায্য কামনা করলেন। তিনি সবার সামনে তার স্বামীকেও পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, তিনি হলেন এ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। আমি কিছুদিনের মধ্যে আপনাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দেব। আমরা সবাই মিলে শিগগিরই অচিনপুরকে সুন্দর একটি রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলব।
গ্রামবাসী নতুন রানি পেয়ে খুব খুশি হলো। তারা নতুন রানির জন্য রাজপ্রসাদ তৈরি করল। রানি এবং প্রধানমন্ত্রী তাদের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য অনেক লোককে নিয়োগ দিল। তারা সবাই সুন্দরভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকল। গ্রামাবাসী সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে থাকল। কিন্তু কিছুদিন পরেই গ্রামের এক প্রভাবশালী বৃদ্ধ নতুন রানি এবং প্রধানমন্ত্রীকে সন্দেহ করতে শুরু করল। সে তাদের কুঞ্জবন রানির প্রতিনিধি তা বিশ্বাস করল না। এর সত্যতা যাচাই করার জন্য সে কুঞ্জবন রানির সঙ্গে দেখা করার মনস্থ করল। দুদিন পরই সে কুঞ্জবনের উদ্দেশে যাত্রাশুরু করল। অবশেষে কয়েক মাস পর সেই বৃদ্ধ কুঞ্জবন রাজ্যের রাজপ্রাসাদে পৌঁছে গেল। সে রানির সঙ্গে দেখা করে সব ঘটনা খুলে বলল। ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য রানি ওই বৃদ্ধলোকটির সঙ্গে কিছু সৈন্য-সামন্ত পাঠালেন। ঘটনা সত্য হলে কী করতে হবে রানি তাদের সেই নির্দেশনাও দিলেন।
অচিনপুরের উদ্দেশে বৃদ্ধ লোকটির সাহায্যে সৈন্য-সামন্তরা যাত্রা শুরু করল। বেশ কিছুদিন যাত্রা করার পর তারা একদিন অচিনপুরে পৌঁছে গেল। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখল যে এটি কোনো নতুন রাজ্য নয়। কুঞ্জবন রাজ্যেরই একটি অংশ। অনেক দূরে হওয়ার কারণে অচিনপুর কারোর নজরে আসেনি। তারা অচিনপুরের রানি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করল। নতুন রানি ও প্রধানমন্ত্রী কুঞ্জবনের সৈন্য-সামন্তদের দেখা মাত্র চমকে গেলেন। তারা ভাবলেন আমাদের আর রক্ষা নেই। আমাদের প্রাণে মরতে হবে। তাই তারা প্রথমে একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে চেষ্টা করল, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। সৈন্য-সামন্তরা নগেন মাঝিকে দেখেই চিনে ফেলে। তাদের অপকর্ম সব ধরা পড়ে গেল। কুঞ্জবন রানির নির্দেশ মোতাবেন সৈন্য-সামন্তরা তাদের ধরে কুঞ্জবনে ফিরে গেল।
কুঞ্জবনের রানি সব ঘটনা শোনার পর নগেন মাঝি ও তার স্ত্রীর বিচার শুরু করলেন। বিচারে তাদের মৃত্যুদ- দেওয়া হলো। কৃত অপরাধের জন্য তারা রানির নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাইল। তাদের কৃতকর্মের ক্ষমা প্রার্থনা এবং নতুন রাজ্য আবিষ্কার করার বিষয়টি বিবেচনা করে রানি তাদের মৃত্যুদ- মওকুফ করে আমৃত্যু কারাদ- দিলেন। এবার সত্য সত্যই কুঞ্জবনের রানি অচিনপুরকে শাসন করার জন্য একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিলেন। নতুন মন্ত্রীর শাসনব্যবস্থায় অচিনপুরে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে ?এলো। এভাবে অচিনপুরে অধিবাসী সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে থাকল।
"