হাসান শান্তনু

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিনামূল্যের বই ছাপানোর শেষ মুহূর্তেও অনিয়ম

নিম্নমানের কাগজ দিয়ে এবারও ছাপানো হচ্ছে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই। আর এসব বই ছাপানোর শেষ মুহূর্তেও থামেনি অনিয়ম-দুর্নীতি। চলতি বছরের বইয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষের সিল ও স্টিকার দিয়ে পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। কোথাও কোথাও যে পরিমাণ বই দেওয়ার তথ্য চালানে দেওয়া হয়েছে, তা গুনে দেখা যাচ্ছে কম। এদিকে ছাড়পত্র ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় বিনামূল্যের পাঠ্যবই পাঠানো হচ্ছে। অনেক বইয়ের বাঁধাইও হয়েছে অত্যন্ত নড়বড়ে। বই ছাপানোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত নীতিমালা এবারও কয়েক প্রকাশক মানছেন না। এনসিটিবির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনিয়ম ঠেকাতে না পেরে শেষ মুহূর্তে এসে এনসিটিবি দুটি প্রকাশনা সংস্থার ছাপার দরপত্র বাতিল আর সাতটি প্রকাশনীকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর অভিযোগ লিখিত আকারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) জানিয়েছেন কয়েকটি জেলা ও উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরাও এমন তথ্য পেয়েছি, বান্ডেলে কিছু বই কম দেওয়া হয়েছে। অনিয়ম করলে কেউ পার পাবেন না। আমরা তাদের বিল আটকে দেব। নিম্নমানের কাগজের ব্যাপারে এবার আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। যেসব বই নিম্নমানের কাগজে ছাপানো হয়েছে, সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে।

অন্যদিকে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি, ছাপা ও বিতরণ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ছাপা ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়টি তাই শিক্ষাঙ্গনে এখনো অন্যতম আলোচিত বিষয়। এ অবস্থায় আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর অনিয়ম নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

বই ছাপানোর অনিয়ম খতিয়ে দেখবে কি নাÑজানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী বছরের জন্য বিশেষ আভিযানিক টার্গেট ঠিক করেছে দুদক। ২০১৮ সাল হবে শিক্ষা খাতে দুর্নীতিকারীদের আতঙ্কের বছর। শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতি হলে দেশ ধ্বংসের দিকে চলে যাবে। এখনই সময় সেটাকে থামানো।

এনসিটিবির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, পাঠ্যবই ছাপানোর বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধ করতে গত সপ্তাহে এনসিটিবির তদারকি সভা জরুরি একটি বৈঠক করে। এতে সাতটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ছাপার কাজ বাতিল করা হয়। যেসব প্রকাশনাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছেÑ এনজেল প্রিন্টার্স, পিএ প্রিন্টার্স, ফাইভ স্টার প্রিন্টার্স, ক্যাপিটাল প্রিন্টার্স, সাহারা প্রিন্টার্স, জাতীয় মুদ্রণ ও ময়না প্রিন্টার্স। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ আরো কয়েকজন এনসিটিবির কাছে বান্ডিলে বই কম দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।

এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক উইং থেকে জানা গেছে, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্ভাব্য মোট শিক্ষার্থী ধরা হয়েছে চার কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬৩ জন। তাদের জন্য মোট ছাপানো হচ্ছে ৩৫ কোটি তিন লাখ ২৬ হাজার ২০৭ কপি পাঠ্যবই।

তথ্য অনুযায়ী, নিম্নমানের হওয়ায় এবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ বাজেয়াপ্ত করে এনসিটিবি। প্রাথমিক পর্যায়ের বই ছাপায় নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করায় বলাকা প্রিন্টার্সের প্রায় ২০০ টন, লেটার অ্যান্ড কালারের ২০০ টন, লেখন আর্ট প্রেসের ১০০ টন, এস আর প্রিন্টার্সের ১১০ টন, প্রিয়াংকার ১০০ টন, জুপিটার ও সীমান্ত দুটি প্রিন্টার্সের আলাদা প্রায় ২০০ টন, সাগরিকার প্রায় ২৯০ টন, পিএ প্রিন্টার্সের ৫০ টন ও পেপার প্রেসের ৫৯০ টনসহ প্রায় ১৫ হাজার টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ছোট ছোট আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ বাতিল করা হয়েছে।

তথ্যমতে, কয়েকটি বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানও পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য নিম্নমানের কাগজ কিনে মাস দুয়েক আগে গোডাউনে জমা রাখে। প্রতিষ্ঠানগুলো নভেম্বর মাসের শেষদিকে এসব কাগজ দিয়ে বই ছাপানো শুরু করে। এনসিটিবির কড়া নজরদারি না থাকায় নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর সুযোগ নেয় অসাধুচক্র। চার রঙের পাঠ্যবই ৮০ গ্রাম সাদা কাগজে ছাপার যেসব শর্ত ছিল, তা কয়েকটি প্রকাশনী মানেনি।

দরপত্রের শর্তানুযায়ী, ৮০ গ্রাম কাগজে বই ছাপার কথা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কাগজের মান সর্বোচ্চ ৫৫ থেকে ৬০ গ্রাম। ফলে তাদের ছাপানো বইয়ে ছাপা অস্পষ্ট হচ্ছে। ঠিকমতো বাঁধাই করাও সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকটি ছাপাখানায় এমনভাবে বাঁধাই করেছে, বই মেলতে গেলেই সুতা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ছবি থেকে কালি উঠছে। ছবির ব্যক্তিদের চেহারা অনেক ক্ষেত্রে বোঝা যায় না।

জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে চক্রের বিরুদ্ধে পাঠ্যবই ছাপানো নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠছে। তবে এ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এনসিটিবি। ২০১৪ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর ক্ষেত্রে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করে প্রায় ৮৪ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ আছে কার্যাদেশপ্রাপ্ত কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় চক্রের সদস্যরা অনিয়মে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন বলেও মনে করেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।

এনসিটিবির পান্ডুলিপি প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও সরবরাহের সর্বমোট ২০টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয় টিআইবির প্রতিবেদনে। এ কাজে জড়িত এনসিটিবির কর্মকর্তারা জনগণের অর্থ অবৈধভাবে লুটে নিচ্ছেন। এ অপকর্মে চেয়ারম্যান থেকে পিয়ন পর্যন্ত জড়িত। সম্মানীর নামে এ বছরের পাঠ্যবইয়ের কাজ থেকে তারা মোট ৫১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ১৬ দফা সুপারিশ পেশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist