প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
দেরি হওয়ার আগেই সমস্যার সমাধান করুন ওআইসিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
রোহিঙ্গা সমস্যা আরো প্রকট হওয়ার আগেই এটা সমাধানে ওআইসির সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এক হয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিষয়ে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানান। পাশাপাশি তুলে ধরেন বেশ কিছু প্রস্তাবও। ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ওআইসি যেসব উদ্যোগ নেবে, বাংলাদেশ তার সঙ্গে আছে।’ গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা বিষয়ে ওআইসির কনটাক্ট গ্রুপ সভায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ওআইসির মহাসচিব ইউসুফ আল ওথাইমেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমি ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। এ বিষয়ে ওআইসি যেসব উদ্যোগ নেবে, বাংলাদেশ তার সঙ্গে আছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, এই সংকটের মূল মিয়ানমারে। এর সমাধানও মিয়ানমারকেই খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এই জাতিগত নিধনের শেষ চাই। আমাদের মুসলিম ভাই ও বোনদের দুরবস্থাও বন্ধ করা দরকার।’
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধ সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমারের ভেতরেই সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের রক্ষায় ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গঠন করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের নিজ ভূমিতে নিরাপদে ও সসম্মানে ফিরিয়ে নিতে হবে। সেই সঙ্গে কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগের দাবি জানান তিনি। ‘জোরপূর্বক বের করে দেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর মতে, মিয়ানমারে ‘শুদ্ধি অভিযান’-এর নামে চলমান সামরিক অভিযানে রাখাইন রাজ্যের মুসলমানদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি জানান, রাখাইনে মুসলিম নিধন অভিযান শুরুর পর গত ২৫ আগস্ট থেকে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের ৬০ শতাংশই শিশু। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা একটা অসহনীয় মানবিক বিপর্যয়। আমি নিজে সেখানে গিয়েছি এবং তাদের কাছ থেকে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা শুনেছি।’
এ সময় শেখ হাসিনা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (ওআইসি) দেশের নেতাদের বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। স্পষ্ট জানিয়েছি, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতেই হবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনে এক বেলা খেয়েও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে, কিন্তু এই শরণার্থীদের যে ফিরিয়ে নিতে হবে, সে কথা মিয়ানমারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারকে আমরা বলেছি, আপনাদের নাগরিক, তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে নিরাপদ রাখতে হবে। তাদের আশ্রয় দিতে হবে। তাদের ওপর জুলুম-অত্যাচার চলবে না।’
ম্যানহাটনের ম্যারিয়ট হোটেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে জনাকীর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘তাদের (মিয়ানমার) ওপর যেন চাপ সৃষ্টি হয়। তাদের নাগরিক তারা ফেরত নিয়ে যাবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে-সেটাই আমরা চাই।’
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে দেশের বিভিন্ন খাতের অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে দুর্ভাগ্য যে, মিয়ানমারে যে ঘটনা ঘটেছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা-এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি যেখানে সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে দলে দলে মানুষ এসেছে, আমরা কী করব? মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে।’
কক্সবাজারে গিয়ে নিজের চোখে রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশা দেখে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার কেবল নিজেদের কথা মনে হয়েছে। আমরাও তো এক দিন এভাবে ওই হানাদার পাকিস্তানিদের কারণে এ ঘর থেকে ওঘরে আমাদের আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে হয়েছে। আমাদের ঘড়বাড়ি সব জ্বালিয়ে ছারখার করেছে। সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে। মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমাদের দেশের মানুষও তো আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ছিল। আজকে যখন তারা বিপদে পড়েছে, অবশ্যই তাদের জায়গা দিতে হবে।’
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, এত মানুষের খাবার দেবেন কিভাবে? আমি তাদের একটা কথাই বলেছি, ১৬ কোটি মানুষ আমাদের। এই ১৬ কোটি মানুষকে যদি খাবার দিতে পারি, তাহলে এই সাত-আট লাখকে খাবার দিতে পারব না?’
বাংলাদেশের মানুষকে ‘অনেক উদার’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে তারা এক বেলা খাবে। অন্য বেলার খাবার এই আশ্রিত মানুষকে তুলে দেবে, সেই মানসিকতা তাদের আছে। আমরা সেখানে লঙ্গরখানা খুলে দিয়েছি, চিকিৎসা, থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’ কিন্তু মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতেই হবে, জোরের সঙ্গে বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোনো দেশে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটুক, তা বাংলাদেশ চায় না। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে প্রতিবেশী কোনো দেশে কাউকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে দেওয়া হবে না-সরকার তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই।’
এসডিজি অর্জনে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবার জন্য টেকসই উন্নয়নের সফল বাস্তবায়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়নে তাদেরকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিবর্তনের অতি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হচ্ছে নারী। এজন্য সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলসের (এসডিজি) সফল বাস্তবায়নে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। সবক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বিশ্ব সবার জন্য টেকসই উন্নয়ন অর্জনে কার্যকরভাবে সফল হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। গতকাল বুধবার জাতিসংঘ সদর দফতরে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মহাসচিবের উচ্চপর্যায়ের প্যানেলের গোলটেবিল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের উচ্চপর্যায়ের প্যানেলে সুপারিশ এগিয়ে নিতে গ্রুপ অব চ্যাম্পিয়ন্স ফর উইমেনস ইকোনমিক অ্যাম্পাওয়ারমেন্ট এবং ইউএন উইমেন এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট রিকা লুুইস গুল্লারমো সলিস রিভেরা, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টাইন লাগার্দে ও ইউএন উইমেনের ফুমজিল ম্লামবো গচুকা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারের নিম্ন থেকে উচ্চ সবস্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া এসডিজি অর্জনে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন কর্মকান্ডে ২৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকার শ্রম ও উদ্যোক্তা খাতে নারীর সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সক্রিয় পরিবেশ গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
সফল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীদের সামনের সারিতে আনতে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের উল্লেখ করে বলেন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন সামরিক বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাস্তবায়ন সংস্থায় নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে কর্মরত নারীদের জন্য পূর্ণ বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনে যোগদানকারী রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মানে জেনারেল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আয়োজিত আনুষ্ঠানিক মধ্যহ্নভোজে যোগ দেন।
"