নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৩ অক্টোবর, ২০১৯

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে কার কী অবস্থান

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্র বিক্ষোভের দাবির মুখে নিজ ক্ষমতাবলে ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন এবং ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রীও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত দেননি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম গত শুক্রবার এক সমাবেশে ক্যাম্পাসে সব ধরনের র?্যাগিং ও নির্যাতন বন্ধ করার কথা জানিয়ে বলেছেন, এ ধরনের নির্যাতন প্রতিরোধে একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে তোলা হবে যেখানে পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানাতে পারবেন। এসব অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ত্বরিত ব্যবস্থা নেবে।

গত ৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এমন ঘটনা ঘটেছে বলেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে কেন? এটা তো সামরিক স্বৈরাচারের মানসিকতা। আমিও ছাত্ররাজনীতি করেই এখানে এসেছি। তাই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়। তবে বুয়েটসহ কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে নিজেরা সেটি করতে পারে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি চলবে কিনা সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। গতকাল শনিবার সকালে নিজের নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরে সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।

‘সব ক্ষেত্রে রাজনীতিকে দোষ দিলে হবে না’ মন্তব্য করে দীপু মনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘রাজনীতি ছাড়া দেশ চলে? আপনি যা কিছু করবেন, তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই চলে। কিন্তু রাজনীতিটা যেন সুষ্ঠু হয়, সুস্থ ধারার হয়। রাজনীতিকে যেন কেউ ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোনো অপকীর্তি করতে না পারে।’

এদিকে আইন করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, ‘১৮ বছর বয়সে মানুষের কথা বলার অধিকারÑ এটা ফ্রিডম অব স্পিচ। একজন ছাত্র, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে যদি স্বাধীনভাবে কোনো কথা বলে, সংবিধান লঙ্ঘন না করে যে কোনো বিষয়ে সে বলতেই পারে। আপনি তো আইন করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে পারবেন না।’ গতকাল শনিবার গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।

এ সময় মন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই ছাত্ররাজনীতি রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিজেপি, কংগ্রেস তাদেরও ছাত্র সংগঠন রয়েছে। এমনকি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্ররাজনীতি রয়েছে। সেখানেও স্টুডেন্টস ইউনিয়ন রয়েছে।’

মন্ত্রী আরো বলেন, তবে ছাত্ররাজনীতি হতে হবে স্বচ্ছ, সুন্দর এবং নৈতিক। ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে আমরা না। এটা মানুষের মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার মধ্যে ছাত্ররাজনীতি করতে হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে পেশিশক্তির ব্যবহার কোনো ক্রমেই করতে দেওয়া যাবে না।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে ডাকসুর সাবেক ভিপি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত দেননি। বরং ছাত্রদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ভয়হীন পরিবেশের ওপর গুরুত্ব দেন তারা।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয় মন্তব্য করে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেছেন, এতে অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।

জয় বলেন, ছাত্ররাজনীতি না থাকলে সেখানে অবশ্যই স্বাধীনতাবিরোধীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি না থাকলে সেখানে স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ঘটতে পারে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়টি আরেকবার বিবেচনা করার জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

অপরদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর বলেছেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বার্থে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ কিংবা বৃহত্তর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমরা এটাতে নাক গলাব না।’ গতকাল শনিবার মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে ভিপি নুর এ কথা বলেন।

ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ক্যাম্পাসগুলোতে ১৯৭৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৫১টি ছাত্র হত্যাকান্ড হয়েছে। একমাত্র ঢাবির মুহসীন হলে সাত হত্যাকান্ড ছাড়া কোনো একটি ঘটনার বিচার হয়নি। যার কারণে এ ধরনের হত্যাকান্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তাই আমরা চাই, ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য বন্ধ হোক। এই কলুষিত ছাত্ররাজনীতির জন্য শুধু ছাত্ররাই দায়ী নয়, প্রশাসনও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।

অপরদিকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট। জোটের অভিযোগ, বাস্তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির ওপর নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের পক্ষ থেকে আবরার ফাহাদসহ ক্যাম্পাসগুলোয় সব হত্যাকান্ডের বিচার ও রায় অবিলম্বে কার্যকর, আবাসিক হলগুলোয় টর্চার সেল ও গেস্টরুম নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা, সব শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সব ক্যাম্পাসে সব ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি করার অধিকার এবং রাজনীতির নামে কেউ অপরাজনীতি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অধ্যাদেশ অনুযায়ী বুয়েটে আগে থেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ আর গত এক দশকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতিই ছিল না। সেখানে রাজনীতির নামে ছিল ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আর নির্যাতন। বিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠন ওই ক্যাম্পাসে কাজ করতে গেলে নির্মমভাবে তাদের দমন করা হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এর আগেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন তকমা দিয়ে মারধর করা হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে বুয়েট প্রশাসন কখনোই ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের এই নির্লিপ্ততা প্রকারান্তরে পৃষ্ঠপোষকতারই নামান্তর। এখানে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এই ঘটনার মূল উৎস যে অগণতান্ত্রিক চর্চা, সেই চর্চাকেই আড়ালে আরো শক্তিশালী করার আয়োজন করেছে বুয়েট প্রশাসন। এরই মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৫৮টি টর্চার সেলের কথা পত্রিকায় এসেছে। তারা একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখে। শিক্ষার্থীদের এই ভয়ই ক্ষমতাসীনদের শক্তি ও লুটপাটের রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close