কক্সবাজার প্রতিনিধি

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

দুই বছরে ধরা ৩ শতাধিক

এখনো পাসপোর্ট পেতে মরিয়া রোহিঙ্গারা

কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের নাইক্যংদিয়া গ্রামের মনজুর আলম নিজের মেয়ে সাজিয়ে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে নিয়ে আসেন রোহিঙ্গা তরুণী আসমাকে (ভুয়া নাম)। উদ্দেশ্য হলো আসমার পাসপোর্ট করাতে হবে। পাসপোর্ট ফরম ও অন্য কাগজপত্রের সঙ্গে ওই নামে পোকখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সই করা জন্মনিবন্ধন সনদও রয়েছে। কিন্তু ওই তরুণীকে দেখে এবং তার কথা-বার্তা শোনার পর সন্দেহ হয় পাসপোর্ট কর্মকর্তার। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। ভুয়া নাম ব্যবহার করে আসমা নামে পাসপোর্ট করতে এলেও তার প্রকৃত নাম রশিদা। উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে রশিদা নামেই তার নিবন্ধন করা হয়েছে। পরে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২৬ আগস্ট এই ঘটনা ঘটে।

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আবু নায়েম মাসুম জানান, এভাবে ভুয়া নাম এবং ভুয়া বাবা-মা সেজে পাসপোর্ট করতে এসে গত দুই বছরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণী তার হাতে ধরা পড়েছে। এদের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে গত ৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার রাজা পালং ইউনিয়নের লম্বাঘোনা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল জলিল জুমজুম নাহার নামের এক রোহিঙ্গা তরুণীকে নিজের মেয়ে সাজিয়ে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আসেন। কিন্তু পরে তাদের আচার-আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে দুজনকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে বের হয়ে আসে আসল তথ্য। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, জুমজুম নাহার আবদুল জলিলের মেয়ে নন। দুই বছর আগে মিয়ানমারের রাসিদং থেকে এসে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রিত সে। কিন্তু এ রোহিঙ্গা তরুণীর ফাইলেও উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর সই করা জাতীয়তা ও জন্ম সনদ রয়েছে।

জানা গেছে, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন থেকে ভুয়া এসব সনদ নিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। পরে এ পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আর আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসব অপকর্মে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছে একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র ও কতিপয় জনপ্রতিনিধি।

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আবু নায়েম মাসুম বলেন, যেসব রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট করতে আসছে এদের বেশির ভাগই নারী এবং এক তৃতীয়াংশ তরুণী। বেশির ভাগের বয়স ২২ বছরের মধ্যে। এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে এক শ্রেণির দালালচক্র জড়িত। তা না হলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে পাসপোর্ট অফিস পর্যন্ত আসা সম্ভব নয়। এসব দালালরাই স্থানীয় লোকজনকে ম্যানেজ করে বাবা-মা সাজিয়ে নিয়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে ইউনিয়ন থেকে রোহিঙ্গা নারীদের ভুয়া জন্ম সনদ, ভুয়া নাগরিকত্ব সনদ নেওয়া হচ্ছে সেই সনদের লেখা এবং পাসপোর্ট ফরমের হাতের লেখা একজনের। এমনকি কেউ কেউ ইউনিয়ন পরিষদের সিলসহ নিয়ে আসছে। তাতে মনে হয় ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রিক একটি দালাল চক্র এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

পাসপোর্ট অফিসের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রথম দিকে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে নিয়ে আসত। এখন কাগজপত্রের বিষয়ে তারা অনেক সচেতন হয়ে গেছে। পাকাপোক্ত ডকুমেন্ট নিয়ে তারা আসছে। সঙ্গে স্থানীয় কিছু আর্থিকভাবে অসচ্ছল লোকজনকে বাবা-মা সাজিয়ে নিয়ে আসছে। এ কাজটিও হয়তো দালালরা সম্পাদন করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাসপোর্টের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক করা হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে কক্সবাজার জেলায় জন্মনিবন্ধন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়াও দালাল নির্মূল এবং রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নিয়ে বর্তমানে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে বাড়তি সতর্কতা ও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। যে কারণে এখানে ব্যর্থ হয়ে অনেক রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জন্মসনদ সংগ্রহ করছে এবং কক্সবাজারের বাইরে থেকেও পাসপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অনেকে সফলও হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. শাহাজাহান বলেন, অতীতে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস নিয়ে যে বদনাম ছিল, তা এখন নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, একসময় এই অফিসে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করাতে না দিলে পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একদম উল্টো। বর্তমান সহকারী পরিচালক যোগদানের পর এই অফিসটি এখন দালালমুক্ত। দায়িত্বের প্রতি কর্মকর্তার এ আন্তরিকতা অব্যাহত থাকলে এখান থেকে কোনো রোহিঙ্গা পাসপোর্ট নিতে পারবে না।

কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবছার বলেন, রোহিঙ্গাদের ঠেকানো শুধু পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্ব নয়, যেসব জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সনদ দিচ্ছে এবং ভেরিফিকেশনের নামে রোহিঙ্গাদের পক্ষে প্রতিবেদন দিচ্ছে সেইসব পুলিশের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করা ঠেকাতে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় কেউ এসব সনদের জন্য গেলেই এ বিষয়ে ভালো করে খোঁজ-খবর নিয়ে সনদ ইস্যু করতে হবে। এতে অনেকাংশে এ অপরাধ কমে আসবে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, আমার জানা মতে গত দুই বছরে কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেয়েছে এ রকম নজির নেই। আশা করছি ভবিষ্যতেও কোনো রোহিঙ্গা এখান থেকে পাসপোর্ট পাবে না। রোহিঙ্গারা যাতে কোনোভাবেই পাসপোর্ট না পায়, এ বিষয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যদের বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা থেকে যেসব সনদ দেওয়া হয় সেগুলো একাধিকবার যাচাই-বাছাই করে তারপর প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার বিষয়টি ফৌজদারী অপরাধ দাবি করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো.কামাল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করার জন্য জন্ম সনদ, নাগরিকত্ব সনদ দেওয়াসহ কোনো জনপ্রতিনিধি, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি সহযোগিতা দিয়ে থাকে রাষ্ট্রের আইনানুযায়ী তা ফৌজদারি অপরাধ। সেই আইনে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close