গাজী শাহনেওয়াজ

  ২২ আগস্ট, ২০১৯

প্রতিদিনের সংবাদকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম বড়ুয়া

সচেতন হলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামবে

আতঙ্কিত না হয়ে নিজের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ এবং স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) দক্ষ সংগঠক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া। তিনি অরো বলেন, সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হলে এ রোগে আক্রান্ত হলেও মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। গতকাল বুধবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিজ দফতরে বর্তমান আলোচিত ডেঙ্গু রোগ থেকে কীভাবে সুরক্ষা পাওয়া যাবেÑ এ বিষয়ে এক সাক্ষাতে ডা. উত্তম কুমার ওইসব কথা বলেন।

বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, এডিস মশাকে বলা হয় এলিট মশা। এরা সাধারণত বিশ্বের জিওট্রপিক্যাল ও সাব-ট্রপিক্যাল দেশগুলোতে বংশবিস্তার করে। এর কারণ তাপমাত্রা ও জলীয় বাম্প। যার কারণে বিশ্বের ১২৮টি দেশে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে বা হচ্ছে। এটার একটা আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার বিষয় রয়েছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই রোগটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকায়ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা দিচ্ছে। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়া বলেন, বিগত ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু নামক মশার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। গত ২০ বছরের মধ্যে চলতি বছরেই সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে যা আশঙ্কাজনক। এটির এলিট শ্রেণির বলা হয়ে থাকে এজন্য যে, ভদ্র, স্বচ্ছ ও ন্যাচারাল পানিতে বংশবিস্তার করে থাকে। এটাই এ মশার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বলা যায়, যোগ করেন বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক।

সংখ্যাধিক্যের প্রসঙ্গ আসতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এই পরিচালক বলেন, বিশ্বে সাড়ে ৩ হাজারের মতো বিভিন্ন প্রজাতির মশা রয়েছে। তবে তিনটি মশাই মানুষের প্রাণনাশের জন্য হুমকি। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে মশায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করানো সম্ভব হলে মৃত্যুর ঝুঁকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

এক্ষেত্রে একটি মশা হচ্ছে, অ্যানোফিলিস মশা, এটার উৎস পার্বত্য এলাকা বা পাহাড়ি এলাকা। দ্বিতীয় কিউলেস মশা; এতে আক্রান্তের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। এই মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ফাইলেরিয়া রোগে আক্রান্ত হবেন।

আর তৃতীয়টি এডিস মশা; ভয়ঙ্কর ও গুরুতর যা মানবদেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ মশায় কামড়ালে চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস এবং ডেঙ্গু হয়ে থাকে। আবার ডেঙ্গুর ধরন দুইটিÑ একটি এডিস এজিপটি অন্যটি এডিস অ্যালবোপিকটাস। এ দুটির মধ্যে এডিস এজিপটি মানুষের জন্য আতঙ্ক এটির উৎপত্তিস্থল শহর ও আশপাশের এলাকা। এজিপটির ক্যাটাগরি চারটি ১, ২, ৩ ও ৪। আর এডিস অ্যালবোপিকটাস মানবদেহে ততটা ক্ষতিকর না হলেও এ মশাটি জঙ্গল বা গ্রামে থাকে। এ ক্যাটাগরির মশা কিছু ভীরু ও কম শক্তিশালী। ফলে শহরের তুলনায় গ্রামে আক্রান্তের হার কম যা ইতিবাচক।

কোথায় এবং কীভাবে বংশবিস্তার করে থাকে এডিস মশা এ প্রসঙ্গ টেনে স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) যুগ্ম সচিব ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া বলেন, একটি পরিষ্কার বালতিতে মাত্র ৫ সিসি সমপরিমাণ পানি জমা থাকলে এবং ওই জমানো পানির সময়ক্ষণ ৩-৫ দিন হলে এডিস মশার লার্ভা বা ডিম ছাড়ে। কিন্তু আশ্চর্য বা বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর এডিস মশা কখনো যেখানে পানি প্রবাহ থাকে, বাতাস যেখানে চলাচল করে কিংবা অতিরিক্ত সূর্যকিরণ রয়েছে সেখানে বালতি কিংবা ড্রামভর্তি পানি থাকলেও ডিম কিংবা বংশবিস্তার করে না। কিন্তু ওই পরিমাণ পানি অথবা ৫ সিসি পরিমাণ পানি খাওয়ার টেবিল, খাটের নিচে, ফ্রিজ, এসি, কাপড়ের ভাঁজেও বংশবিস্তার করতে পারে। কিন্তু সে বেশিদূর উড়ে যেতে পারে না; এটা আমাদের জন্য সুখবর। সীমিত জায়গার মধ্যে ঘোরাফেরা করে।

এডিস মশা পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ই ধরনের হয়ে থাকে। একটি পুরুষ মশা ৭-১০ দিন আয়ুষ্কাল থাকলেও স্ত্রী মশার আয়ুষ্কাল থাকে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত। এ হিসাবে বলা যায় স্ত্রী মশাই বেশি ভয়ঙ্কর। এই মশা প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ২০০টি ডিম পাড়ে, দৈনিক ৫-৬টি জায়গায় চলাফেরা বা যেতে পারে এবং ৫ থেকে ১৭ জন মানুষকে একটি মশা কামড়াতে পারে।

এই প্রসঙ্গে ডা. উত্তম কুমার বলেন, এই রোগের উত্তম পন্থা হলো নিয়ন্ত্রণ করা। এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির জন্য মশারির মধ্যে অবস্থান করা, নেট দিয়ে রুমগুলোকে আবৃত্তি করে রাখা এবং আরো সুরক্ষায় এরোসল, ওডোমস ও কয়েল ব্যবহার করা। এছাড়া ফুলপ্যান্ট ও ফুলহাতা শার্ট পরা এবং জুতার সঙ্গে মোজা পড়াও জরুরি।

অপর এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচতে বিশেষ করে গর্ভবর্তী মহিলা, কিডনি, ডায়াবেটিস এবং হার্টের রোগীদের বর্তমান অবস্থায় সার্বক্ষণিক মশারির মধ্যে রাখা উত্তম। কারণ এসব রোগীদের এডিস এজিপটি মশা কামড়ালে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই উচিত। অন্যথায় বিলম্বিত হলে এ ধরনের রোগীদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন।

আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই উল্লেখ করে সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালের এই পরিচালক বলেন, এ রোগের সম্ভাবনা দেখামাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। কারণ চলতি বছরে ব্যাপক আকারে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লেও এ হাসপাতালে ৬০-৭০ শতাংশ রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। কারণ এ রোগের অন্যতম চিকিৎসা প্যারাসিটামল, স্যালাইন এবং পরিপূর্ণ বিশ্রাম। পাশাপাশি তরল খাবার খাওয়ানো। আর বাকি ৩০ শতাংশ রোগী যারা বেশি আক্রান্ত তাদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর ব্যথানাশক ওষুধ এবং সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন থেকে বিরত থাকায় শ্রেয়। যদি পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকে সেক্ষেত্রে ব্যথানাশক কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে চাইলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সচেতন হলেও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close