নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পুলিশকে প্রধানমন্ত্রী

নিরীহ মানুষ যেন হয়রানি না হয়

* মাদক নির্মূল ও নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে কাজ করার নির্দেশ * পদক পেলেন ৩৪৯ কর্মকর্তা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সততা-নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে জনগণের আস্থা অর্জন এবং জনবান্ধব হতে পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আপনাদের মনে রাখতে হবে, দেশের নিরীহ জনগণকে কোনো ধরনের হয়রানি বা পীড়ন করা যাবে না। জনগণ হয়রানির শিকার হলে বা বিপদে পড়লে তাদের সহযোগিতা করুন। জনগণ এটাই আপনাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে। গতকাল সোমবার ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ‘পুলিশ সপ্তাহ ২০১৯’ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

সরকারপ্রধান বলেন, পুলিশের প্রত্যেক সদস্যের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালনের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করে জনবান্ধব পুলিশে পরিণত হবেÑ এটাই আপনাদের কাছ থেকে আমি আশা করি। আমরা চাই আমাদের পুলিশ বাহিনী হবে জনবান্ধব পুলিশ। সেভাবে আপনারা নিজেদের গড়ে তুলবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধৃৃত করে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ?আমি পুলিশ বাহিনীকে এটুকু বলব, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আপনাদের যে কথা বলেছেন আপনারা বাংলাদেশেরই বিভিন্ন পরিবার থেকে এসেছেনÑ আজকে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে শান্তি নিরাপত্তা থাকা মানে হচ্ছে আপনাদের পরিবারের সদস্যদের শান্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশ আমাদের, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কাজেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা একান্তভাবে প্রয়োজন এবং জরুরি। দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা এটা আপনাদের দায়িত্ব। আপনারা নিজের দেশ, নিজেদের পরিবারের কথা চিন্তা করে এই দেশকে আরও উন্নত রাখবেন। একটা বিষয় লক্ষ্য রাখবেন আপনাদের হাতে কোনো নিরীহ জনগণ যেন নির্যাতনের শিকার না হয় বা কোনো রকম হয়রানির শিকার যেন না হয়। বরং কোনো হয়রানি হলে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা এটা আপনাদের কর্তব্য। এটাই জনগণ আপনাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেÑ বলেন সরকারপ্রধান।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপ এবং সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে ক্রাইমেরও ধরন পাল্টে যাচ্ছে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদেরও সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ক্যাডার কর্মকর্তাসহ সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে যাওয়ার আগেই বুনিয়াদি ও মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের আমরা ব্যবস্থা করছি। এই প্রশিক্ষণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে।

মাদক নির্মূলে ও নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে পুলিশ বাহিনীকে যথাযথভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাদক নির্মূলের যে অভিযান আমাদের চলমান, এটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি সেগুলো যথাযথভাবে পালন করা একান্তভাবে প্রয়োজন।

জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদক নির্মূলে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর সুফল এবং এক্ষেত্রে পুলিশের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জাতীয় জরুরি সেবাÑ ৯৯৯ এর কার্যক্রমের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে জরুরি সেবা (ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশ) প্রাপ্তি সহজতর হয়েছে, মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ পুলিশের অনলাইন ভিত্তিক সেবা প্রদান, মোবাইল অ্যাপস প্রবর্তন এবং তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণে বিভিন্ন সফটওয়্যার সংযোজন ও ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের প্রশংসা করেন তিনি।

ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম, মানিলন্ডারিং, সাইবার ক্রাইম এবং সমসাময়িক অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণেও পুলিশ সদস্যদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন ও সদস্যদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থকে ব্যয় হিসাবে ধরি না, জনগণ সেবা পাচ্ছে বলেই আমরা ধরে নিই।

উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গঠনে সবার সহযোগিতা কামনা করে টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমরা সবার সহযোগিতা কামনা করি, যেন বাংলাদেশকে আমরা সারা বিশ্বের বুকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, বিগত দিনে বিভিন্ন আন্দোলনের সহিংসতা দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশ সদস্যদের ভূমিকার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।

সকাল সাড়ে ১০টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের অনুষ্ঠানস্থলে এলে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরকে পুলিশের একটি সুসজ্জিত ঘোড়সওয়ার শোভাযাত্রা স্বাগত জানায়। প্যারেড গ্রাউন্ড এলে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। এ সময় পুলিশের একটি চৌকস দল প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। খোলা জিপে প্রধানমন্ত্রী প্যারেড পরিদর্শন করেন। পরে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আবিদা সুলতানার নেতৃত্বে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।

সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদান এবং সেবামূলক কাজের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) পদক পান ৩৪৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পদক পরিয়ে দেন।

এছাড়া অভিযান পরিচালনাকালে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ডিবির ইন্সপেক্টর জালাল উদ্দিনকে এবং ২০১৫ সালে রাজধানীর মৎস্য ভবন এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের পেট্রলবোমায় আহত হয়ে মারা যাওয়া ডিএমপির কনস্টেবল শামীম মিয়াকে মরণোত্তর বিপিএম পদক দেওয়া হয়।

এবার পুলিশ পদক পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান, ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

‘পুলিশ-জনতা ঐক্যের’ সেøাগানে পুলিশ সপ্তাহ শুরু : ‘পুলিশ-জনতা ঐক্য গড়ি, মাদক-জঙ্গি নির্মূল করি’ সেøাগান নিয়ে গতকাল সোমবার থেকে শুরু হলো পাঁচ দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ। সকাল সাড়ে ১০টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে বার্ষিক প্যারেড পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশের বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ১১টি কন্টিনজেন্ট এবং পতাকাবাহী দলের প্যারেড পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন।

২০১৬ ও ২০১৭ সালে পুলিশ সপ্তাহের কুচকাওয়াজের নেতৃত্বে ছিলেন নারী। এক বছর বাদে এবার নেতৃত্ব দেন পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আবিদা সুলতানা। তার নেতৃত্বে পরিচালিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য। এবারের পুলিশ সপ্তাহের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হচ্ছে পুলিশ পদক। পূর্ববর্তী বছরের কাজের মূল্যায়ন করে এই পদক দেওয়ার বিধান রয়েছে।

সদ্য শেষ হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় এক মাসের মধ্যে এই পুলিশ সপ্তাহে এবার ৩৪৯ জনকে পদক দেওয়া হলো। এর আগে কখনই রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার এত বেশি সংখ্যক সদস্যকে পদক দেওয়া হয়নি। গত বছর ১৮২ জন পদক পেয়েছিলেন। তার আগের বছর ২০১৭ সালে পেয়েছিলেন ১৩২ জন।

২০১৮ সালে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ৪০ জনকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং ৬২ জনকে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) দেওয়া হয়। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামূলক আচরণের মাধ্যমে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য ১০৪ জনকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)- সেবা এবং ১৪৩ জনকে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)- সেবা প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে বিপিএম-মরণোত্তর পদক প্রদান করা হয়েছে পরিদর্শক মো. জালাল উদ্দিন ও কনস্টেবল মো. শামীম মিয়াকে। তাদের পরিবারের সদস্যরা এ পদক গ্রহণ করেন।

৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ-সংক্রান্ত মতবিনিময় সভার মধ্য দিয়ে শেষ হবে ২০১৯ সালের পুলিশ সপ্তাহের আয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close