প্রতীক ইজাজ

  ১২ নভেম্বর, ২০১৮

নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট

অবশেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গতকাল পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দুই জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। দুই জোটই বর্তমান তফসিল বাতিল করে ভোট এক মাস পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এ দাবিতে তারা নির্বাচন কমিশনে চিঠিও দিয়েছে। তবে ভোট পেছানো হবে কিনা সে ব্যাপারে আজ সিদ্ধান্ত জানানোর কথা নির্বাচন কমিশনের।

দুই জোটের নেতারা মনে করছেন, পুনঃতফসিল না হলে অল্প সময়ের মধ্যে ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া কষ্টসাধ্য হবে। এরই মধ্যে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ৭ দিন ভোট পেছানোর দাবি করেছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটও পুনঃতফসিল চেয়েছে। এর আগে গত শনিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটি, ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পর পর কয়েক দফা বৈঠক হয়। সেখানে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও সবকিছুই গোপন রাখে দুই জোট। শেষ পর্যন্ত কী হয় তা নিয়ে গতকাল দুপুর পর্যন্ত নানা আলোচনা ছিল রাজনীতিতে। অবশেষে মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন বিএনপি, গণফোরাম, জাসদ (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর ফলে গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে সারা দেশে শুরু হওয়া নির্বাচনী উৎসব আরো বেশি গতি পেল। নতুন করে নির্বাচনী ট্রেনে উঠল দেশ।

বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়ায় তাদের স্বাগত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় সংসদীয় বোর্ডের সভায় বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সবাই মিলে নির্বাচন করব। জনগণ যাকে চাইবে তাকে ভোট দেবে সেটাই আমরা করব। তিনি আরো বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই সরকারের লক্ষ্য। জনগণ যাদের ভোট দেবে তারাই বিজয়ী হবে।

তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এর মাত্র ৩ দিনের মাথায় গতকাল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সদ্য গঠিত নির্বাচনী জোট ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতিও শুরু করেছে এই দুই জোট। অবশ্য তারা নির্বাচন এক মাস পেছানোর দাবি জানিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে কোনো ধরনের আপত্তি জানাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর ফলে এই মুহূর্তে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে সব ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটল।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে। আজ থেকে শুরু হচ্ছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জোটগতভাবে মনোনয়ন ফরম বিক্রি। ভোটের উৎসবে থেমে নেই বিভিন্ন দলের পেশাজীবীরাও। নায়ক-নায়িকা, শিল্পী, খেলোয়াড়, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার পরিচিত মুখগুলো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য পছন্দের দলগুলো থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের একাংশও মনোনয়নপত্র বিতরণ ও জমা নেওয়ার তৎপরতা শুরু করেছে। বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টও শিগগির আগ্রহীদের কাছে মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করবে। ইসলামী দলগুলোও ভোটের মাঠে তৎপর রয়েছে। তাদের অধিকাংশই জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে। বাম গণতান্ত্রিক জোট এখন পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো ঘোষণা না দিলেও তাদের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে জোরালো মত রয়েছে।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, যেভাবে নির্বাচনী রাজনীতি এগোচ্ছে তাতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক আভাস মিলছে। নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে এখনো সময় আছে ৭ দিন। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মেরূকরণ সম্পন্ন হবে। কোন দল কোন জোটের হয়ে নির্বাচন করবে সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে কয়েক দিনের মধ্যেই। এ সময়ের মধ্যে নেতৃস্থানীয় দলগুলো শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। মত-পথের পার্থক্য সত্ত্বেও এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথেষ্ট অংশগ্রহণমূলক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এর আগে গত ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন হওয়ার কথা। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ১৯ নভেম্বর, বাছাইয়ের তারিখ ২২ নভেম্বর ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৯ নভেম্বর।

নির্বাচনী উৎসবে আওয়ামী লীগ : নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর দিন গত শুক্রবার থেকে মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে প্রথম দিনে ১ হাজার ৩২৮ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী ফরম তুলেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হচ্ছে ৩০ হাজার টাকায়। গতকাল জোটগতভাবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে ইসিতে চিঠি দিয়েছে দলটি। তবে কত দল এই জোটে থাকবে গোপনীয়তার স্বার্থে তা জানানো হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছে দলের পক্ষ থেকে চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়।

নির্র্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি : গতকাল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের একাধিক সূত্র জানায়, শনিবারের বৈঠকে শরিক দলগুলোর লিখিত মতামত নেয় বিএনপি। সেখানেই অধিকাংশ শরিক দল নির্বাচনের পক্ষে মত দেন। সেক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে পলাতক থাকায় দলীয় মনোনয়নপত্রে দলের পক্ষ থেকে সই করার ক্ষমতা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দেওয়া হয়।

গতকাল বিএনপি তাদের জোটের সাত শরিক দলকে ধানের শীষ প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি দিতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে। এছাড়া আজ থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করবে দলটি। দলের আগ্রহী প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম তুলতে পারবেন নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। মনোনয়ন ফরমের মূল্য সম্ভবত ৩০ হাজার টাকা হতে পারে।

নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট : গতকাল দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের জন্য লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ডের ন্যূনতম শর্তও পূরণ হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়। তারপরও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন এ আশাও ব্যক্ত করেন যে, এ ঐক্যবদ্ধ শক্তি নির্বাচনে জনগণের আস্থা অর্জন করে জনগণের মালিকানা কায়েম করবে। তবে প্রতীকের ব্যাপারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পরে জানাবে বলে জানান নেতারা। বিএনপির মতো ঐক্যফ্রন্টও বর্তমান তফসিল আরো এক মাস পিছিয়ে দিয়ে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবি করেছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়াকেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এছাড়া ফ্রন্টের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয়েছে, দাবি মানা না হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে।

নির্বাচনী আমেজে জাতীয় পার্টি : জাতীয় পার্টি জানিয়েছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিলে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জোট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অংশীদার হয়ে নির্বাচনে যাবে। আর ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অংশ না নিলে এরশাদের জোট আলাদাভাবে নির্বাচন করবে বলে সিদ্ধান্ত রয়েছে। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে নির্বাচনী উৎসবের হাওয়া বইছে দেশে।

গতকাল ঢাকা-১৭ আসনে নিজ মনোনয়নপত্র সংগ্রহের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপত্র বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সকালে রাজধানীর গুলশানে ইমানুয়েল কনভেনশন হলে নেতাকর্মীরা উৎসবমুখর পরিবেশে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। এ সময় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।

দলীয় সূত্র মতে, নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় পার্টি। পাশাপাশি জোটগতভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও রয়েছে তাদের।

নির্বাচন পেছালে আপত্তি করবে না আওয়ামী লীগ : নির্বাচন এক মাস পিছিয়ে তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ আরো কিছু রাজনৈতিক দল। এ ব্যাপারে গতকাল নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি। ঐক্যফ্রন্টের লিখিত বিবৃতিতে নির্বাচন পেছনোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন চার দলীয় জোটের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তফসিল দুই দফা পেছানো হয়েছিল।

অবশ্য এ নিয়ে ইসির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের কোনো আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক জোটগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটের তারিখ পিছিয়ে দিলে তাতে তার দল আপত্তি করবে না। তবে নির্বাচন পেছানো হলে তা যৌক্তিকভাবে করতে হবে এবং যে দলগুলো জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করবে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তা করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close