প্রতীক ইজাজ ও বদরুল আলম মজুমদার

  ২৯ এপ্রিল, ২০১৮

জয় পেতে বিশেষ নির্বাচনী কৌশল

সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে দুই দল

দুই সিটির নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে বড় দুই দল। এ নির্বাচনকে দুই দলই দেখছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নির্বাচন যেমন মর্যাদার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য; তেমনি জাতীয় রাজনীতিতে দলের অস্তিত্বের অংশ হিসেবে দেখছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ চাইছে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হারানো নগরপিতার পদ পুনরুদ্ধার করে দেশের মানুষের কাছে সরকার ও দলের জনপ্রিয়তা এবং সব দলের অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে। পক্ষান্তরে নগরপিতার আসন ধরে রাখতে মরিয়া বিএনপিও। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নেওয়া এ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে দলটি চাইছে সংগঠনকে সুসংগঠিত করে জাতীয় নির্বাচনে শক্তভাবে অংশ নিতে।

নির্বাচনে জয়ের জন্য মরিয়া দুই দলই। সে লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্বাচনী কৌশলও। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত দেশের পাঁচ সিটির নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে এ নির্বাচনে দলীয় প্রচার কৌশল পাল্টেছে। ওই নির্বাচনে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটিতে পরাজয় হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের। তাই এবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্রের চেয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের বেশি সম্পৃক্ত করতে চায়। দলের শীর্ষ নেতারা ভাবছেন, স্থানীয় নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলেই দলীয় প্রার্থীর জয় আসবে। এজন্য সবার আগে দলীয় কোন্দল নিরসন করে সাংগঠনিক ঐক্যের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে দল।

আওয়ামী লীগ চাইছে, এ নির্বাচনে জাতীয় ইস্যু না আসুক। সেজন্য স্থানীয় ইস্যুকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণায় কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণও কম থাকছে। এ ক্ষেত্রে কেবল দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাই অংশ নেবেন। বিশেষ করে যেকোনো উপায়ে এ নির্বাচনকে বিতর্কের বাইরে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। যাতে এখান থেকে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে কোনো ধরনের ইস্যু তৈরি করতে না পারে বিরোধীরা।

অন্যদিকে, দুই ধরনের কৌশল নিয়ে মাঠে বিএনপি। জয় ও ভোট সুষ্ঠু হওয়ার শঙ্কাÑ উভয়ই মাথায় রেখেছে দলটি। এ ক্ষেত্রে দুটোতেই লাভ দেখছে। দলের শীর্ষ নেতাদের মতে, এই দুই সিটিতে জয় পেলে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ত্বরান্বিত হবে। নিজেদের জনপ্রিয়তা নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের মাঠে শক্ত অবস্থান নিতে পারবে দল। আবার ভোট কারচুপি হলে তা নিয়ে আন্দোলন জোরদার করা যাবে। পরবর্তীতে তা জাতীয় নির্বাচনে ইস্যু তৈরি করা হবে।

এ দুই সিটির নির্বাচনকে অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে দেখছে নির্বাচন কমিশনও। কমিশন মনে করছে, এ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কমিশন বেশ বিতর্কের মুখে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে সরকারেও। সুতরাং যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ অবস্থান রাখতে চায় কমিশন। এজন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ইসি সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই নির্বাচনগুলোকে কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। বিগত দিনে সিটি নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন সফল হয়েছে। এই নির্বাচনও সফল হবে বলে আশা করছি।’

নির্বাচন বিশ্লেষকরাও এই দুই সিটির নির্বাচনকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। বিশেষ করে এই নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলেও মনে করছেন তারা। এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দুই সিটির ভোটে বিজয় অর্জন এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রধান লক্ষ্য। জয় পেতে মরিয়া তারা। তবে খুবই স্পর্শকাতর একসময়ে এই নির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচনের জয়-পরাজয়, ভালো-মন্দ সবকিছুর প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে। ফলে এই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাইবে না কোনো দলই। এমনকি নির্বাচন কমিশনও না। ফলে যেকোনো উপায়ে এই নির্বাচন সুষ্ঠু হতে বাধ্য। আর যদি তা না হয়, সরকার যদি কোনোভাবে এই নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চায়, তা হলে পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। নিশ্চয় সরকার তা চাইবে না।

আগামী ১৫ মে দুই সিটিতে একই দিনে দলীয় প্রতীকে ভোট হবে। মেয়র পদে খুলনায় আওয়ামী লীগের হয়ে লড়ছেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাগেরহাট-৩ আসনের (রামপাল-মোংলা) সাবেক সংসদ সদস্য (মনোনয়নের পর পদত্যাগ করেছেন) তালুকদার আবদুল খালেক এবং গাজীপুরে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম। অন্যদিকে গাজীপুরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী গাজীপুরে দলের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং জেলা বিএনপির সহসভাপতি হাসান উদ্দিন সরকার ও খুলনায় নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু।

আওয়ামী লীগের জন্য মর্যাদার লড়াই : এই দুই সিটির নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ নির্বাচনকে ‘মর্যাদার লড়াই’ হিসেবেও দেখছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, সরকারের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে হলে এবার অবশ্যই জয় পেতে হবে। আবার নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। এই নির্বাচনের ফলাফল ও পরিবেশ জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এজন্য গতবারের এ দুই সিটি ভোটের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন ক্ষমতাসীনরা।

দলের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, সম্প্রতি বেশ কিছু স্থানীয় নির্বাচনের ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছে দলীয় কোন্দলে। তাই গাজীপুর ও খুলনায় দলের সব নেতাকর্মী আন্তরিকতার সঙ্গে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করুকÑ এটাই চায়। গত নির্বাচনের ভোটে যে সমন্বয়হীনতা ছিল, সেগুলো এবার কাটিয়ে উঠতে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠপর্যায় সমন্বয়ে কাজ করছেন। এজন্য কেন্দ্রীয়ভাবে দুটি সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবেও কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করেছে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে দুই সিটিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে ১৪ দল। গাজীপুরে জাতীয় পার্টিও আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে।

জানা গেছে, খুলনার সিটি ভোটে কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত টিমে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পেয়েছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও গাজীপুরে অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি কেন্দ্রীয়, মহানগর এবং জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা প্রচারণায় নেমেছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা ও মহানগর নেতাদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করছেন। নির্দেশ দিচ্ছেন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার।

এ প্রসঙ্গে মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, মূল লক্ষ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। খুলনায় দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে জেলা-মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সব সংগঠনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারাও মাঠে কাজ করছেন।

একইভাবে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘গত নির্বাচনে আমাদের কিছু ভুল ছিল। সে কারণে আমরা বিজয়ী হতে পারিনি। কিন্তু বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়ে গাজীপুরের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। গাজীপুরের মানুষ এখন উপলব্ধি করেন উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। সে কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন।’

জয় পেতে মরিয়া বিএনপি : এই নির্বাচনকে বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও সেভাবেই দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুই সিটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে নির্বাচন পরিচালনা সমন্বয় কমিটিও করা হয়েছে। ২০-দলীয় জোটগতভাবেও পৃথক নির্বাচন পরিচালনা সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।

দলের শীর্ষ নেতাদের মতে, প্রচারণার কৌশল হিসেবে স্থানীয় ইস্যুর পাশাপাশি সরকারের জাতীয় ইস্যুকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও দমন-পীড়নের চিত্র জনগণের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। জাতীয় ইস্যুর সঙ্গে এবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি। সুতরাং এসব দাবিতে সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা সহজ হবে। খালেদা জিয়ার কারাবন্দি অবস্থায় দুই সিটিতে জয়ী হয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চান দলের নীতিনির্ধারকরা। এটা ধরেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাবেন তারা।

এ ব্যাপারে গাজীপুর সিটির প্রধান সমন্বয়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা আগেও বলেছি আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি নির্বাচনে এসেছে। আমরা ধানের শীষে ভোট চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে। বর্তমান সরকারের সময় কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এখানে সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয় কি না, তা নিয়ে আমারা সন্দিহান। এজন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু নাকচ হয়েছে। তার পরও আমরা ভরসা করতে চাই, নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারবে। মানুষের ভোটের অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলে সরকার বুঝতে পারবে জনগণ তাদের কেমন পক্ষে আছে।’

একইভাবে খুলনা সিটি নির্বাচনের সন্বয়ক গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপির লক্ষ্য একটাই, মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। গত চার-পাঁচ বছর থেকে মানুষ ভোট দেওয়া ভুলে গেছে। মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই আজ আমাদের নেত্রী জেলখানায়। আমরা ভোটের অপেক্ষায় আছি। মানুষও সুযোগ খুঁজছে। ভোটের রেজাল্ট দিয়েই প্রমাণ করব নৌকার দিন ফুরিয়ে গেছে। খুলনার মানুষও সেই জবাব দিতে অপেক্ষায় আছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist