হাসান ইমন
রমজানের আগেই বাড়ছে পণ্যের দাম
রমজান এলেই যেন মজুদদার ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। পণ্য মজুদ রেখে দাম বাড়িয়ে মুনাফা লোটার সুযোগ হাতছাড়া করেন না তারা। রমজান এলেই প্রতি বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যবসায়ীরা দাম না বাড়ানোর আশ্বাস দিয়ে থাকেন। কিন্তু এসব আশ্বাস কাজে পরিণত হয় না। বরাবরই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা থাকেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে রোজার প্রয়োজনীয় ছোলা, চিনি, মুড়ি, খেজুর ও বেগুনের দাম।
বাজারসংশ্লিষ্টরা রোজায় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুপারিশ দিয়েছেন। তারা বলছেন, সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকর করা, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি বন্ধ করা, ব্যবসায়ীদের ওপর বাজার নিয়ন্ত্রণের নির্ভরশীলতা কমানো, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পণ্যমূল্যের সামঞ্জস্য নিয়মিত তদারকি করা, চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং রমজানের বিশেষ পণ্যের জোগান বাড়ানো।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রমজান মাসে চিনি, ছোলা, মুড়ি, খেুজর ও পেঁয়াজসহ রোজার প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ে। রোজার আগেই একসঙ্গে বড় ধরনের বাজার করেন ভোক্তারা। এর সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। তারা বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেন। তবে এবার সরকার পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রেখেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও ভোগ্যপণ্যের দাম নাগালে রয়েছে। তাই দাম বাড়ার আশঙ্কা নেই। আর ব্যবসায়ীরা যদি কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন কিংবা পণ্যের ট্রাক সরবরাহে যানজট সৃষ্টি করেন অথবা মনিটরিংয়ের অভাব থাকে, তাহলে দাম বাড়বে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রমজানের পণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে আগাম নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে। রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে ২ দশমিক ৫ লাখ টন, চিনি তিন লাখ টন, ছোলা ৮০ হাজার টন, খেজুর ১৮ হাজার টন এবং পেঁয়াজ চার লাখ টন। এর বিপরীতে দেশে ১৮ মার্চ পর্যন্ত ভোজ্যতেলের মজুদের পরিমাণ আট গুণ বেশি, ছোলা আট দশমিক ৩৩ গুণ, পেঁয়াজ তিন দশমিক ৪৮ গুণ, খেজুর দুই দশমিক ৫৬ গুণ এবং চিনি শূন্য দশমিক ৪৫ গুণ।
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রোজার আগেই ছোলা ও মুড়ির দাম বেড়েছে। ছোলা এখন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭৫-৮০ টাকা। যা গত দুই মাস আগেও বাজারে কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। দুই মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা বেড়েছে। এ ছাড়া গত ১৫ দিন আগে কেজিপ্রতি ৫৫ টাকার চিনি গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকায়। ৬০-৬২ টাকার বিক্রি হওয়া মুড়ি গতকালও বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা কেজি দরে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৮-১০ টাকা। রোজা এলে বেগুনের দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। গত ১৫ দিনে ৩০ টাকার বেগুন গতকাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা। খেজুরের দাম মানভেদে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ ছাড়া খেসারি ৭০ টাকা, ডাবলি ৪০, মুগডাল ১১০ এবং মসুর ডাল মানভেদে ১০০-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ)। সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারি সংস্থাটি। টিসিবিকে অকার্যকর করে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটি চক্র। এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে বাজার বিশ্লেষকদের অভিযোগ।
বরাবরের মতো আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসু। তিনি বলেন, ‘রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সেগুলোর মজুদ বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া টিসিবিতে প্রয়োজনমতো পণ্য মজুদ রাখা হচ্ছে। কোনো রকম সংকটের আশঙ্কা নেই।’ এবার কোনো ধরনের কারসাজির সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, যেহেতু রোজায় চাহিদা বাড়ে, সেজন্য দাম একটু বাড়তে পারে। তবে এবার পর্যাপ্ত আমদানি করা হয়েছে। যদি কোনো কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয় তাহলে দাম বাড়বে না বলে মনে করেন তিনি। সরকারকে বাজার মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়ে সফিউল ইসলাম বলেন, কেউ যাতে রমজাননির্ভর পণ্যে কারসাজি করার সুযোগ না পায়, সেজন্য সরকারের গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করতে হবে।
এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মুখ্য কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, রমজানের বাজার মোকাবিলায় প্রস্তুত টিসিবি। ইতোমধ্যে টিসিবির আমদানি ও স্থানীয়ভাবে ক্রয়কৃত মজুদ পণ্য ভোজ্যতেল, ছোলা, চিনি, মসুর ডাল গুদামে ঢুকেছে। রমজানের ৮-১০ দিন আগ থেকেই খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি শুরু হবে। বাজারদরের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি হবে টিসিবির পণ্য।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে এবার পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে। ভারত থেকেও পেঁয়াজ আসছে। ফলে বাজারে এখন পেঁয়াজের দাম কম। ৩৩-৩৫ টাকায় দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম ২৫-২৮ টাকা। পাইকারি বাজারের বড় বিক্রেতা খলিলুর রহমান বলেন, রোজায় এবার পেঁয়াজের দাম বাড়বে না। পর্যাপ্ত মজুদ আছে। ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১৬০-১৭৫ টাকা পাল্লায় (৫ কেজি) বিক্রি হচ্ছে। আরেক বিক্রেতা আলাউদ্দিন বলেন, দেশে এবার পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে। মানুষ এখন শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য পেঁয়াজ কিনছে। রোজার কেনাকাটা শুরু করেনি। তবে রোজায় দাম বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।
"