জয়পুরহাট প্রতিনিধি

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

চিনিকলের বর্জ্যে দূষিত তুলসীগঙ্গা

জয়পুরহাট চিনিকলে ৬০ বছরেও নির্মিত হয়নি বর্জ্য শোধনাগার। ফলে ওই কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যে নদী ও খাল ছাড়াও দূষিত হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ। পানি থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচকাজ।

জানা যায়, ১৯৬১ সালে ১৮৮ দশমিক ৮৭ একর জমি ওপর নির্মিত হয় জয়পুরহাট চিনিকল। ১৯৬৩ সালে নির্মাণকাজ শেষে বর্জ্য শোধনাগার ছাড়াই চিনি উৎপাদন শুরু করে কর্তৃপক্ষ। তখন থেকেই ওই কারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ। এরই মধ্যে ২০১৮ সালের ১ জুলাই শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে সুগার মিলে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প (ইটিপি) উদ্বোধন করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। ২০১৮ সালের ১ জুলাই শুরু হওয়া এই কাজ ২০২০ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু আড়াই বছর পার হলেও একমাত্র নালা ও ঘর তৈরি ছাড়া কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে প্রকল্পের মেয়াদের বাকি পাঁচ মাসে কাজ শেষ হবে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।

জয়পুরহাট চিনিকল থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য একটি নর্দমার মাধ্যমে পড়ছে আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দীপুর ইউনিয়নের আওয়ালগাড়ি গ্রামের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া শ্রীখাল ও পৌর সদরের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া তুলশীগঙ্গা নদীতে। সরেজমিন দেখা গেছে, জামালগঞ্জ পাঁচ মাথা থেকে তুলসীগঙ্গা নদী পর্যন্ত এবং আক্কেলপুর পৌর শহরের সোনামুখী সেতুর দক্ষিণ পাশের অংশে থেকে শুরু করে তুলসীগঙ্গা নদীর পানির রং কালো। শ্রীখালটি এসে সোনামুখী সেতুর কাছে এসে মিলিত হয়েছে। আর সেতুর উত্তর থেকে দক্ষিণে পানির স্রোত রয়েছে। সেতুর দক্ষিণ পাশ থেকে হলহলিয়া রেলসেতু পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার নদীপথের পানি কালচে রং ধারণ করেছে।

শ্রীখাল ও নদীপাড়ের বাসিন্দারা জানান, জয়পুরহাট চিনিকলে আখমাড়াই কার্যক্রম চলছে। চিনিকলের বর্জ্যে দিনের বেলা ওই নদী ও খালের পানি থেকে দুর্গন্ধ কিছুটা কম হলেও রাতে দুর্গন্ধ বেড়ে যায়। এতে আশপাশের বাসিন্দাদের বসবাস দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে তাদের বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। আওয়ালগাড়ি গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্রীখালের পানি দিয়েই দুই পাশের কৃষি জমিতে সেচ দেওয়া হতো। প্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন ধরে ওই এলাকার কৃষকেরা কোনো কাজেই শ্রীখাল ও নদীর পানি ব্যবহার করতে পারছেন না। তুলসীগঙ্গ নদী ও শ্রীখালের সব মাছ ও জলজ প্রাণী মরে গেছে।

আওয়ালগাড়ি গ্রামের কৃষক আবদুল বাসেদ বলেন, শ্রীখালের পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিতাম। খালের পানি কালচে হওয়ায় জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। পানির অভাবে আমার সবজি খেতের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল বলেন, শ্রীখালের পানি এতটাই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে যে সন্ধ্যার পরে বাড়িতে থাকায় দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

শ্রীখাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি (পাবসস) লিমিটেডের সভাপতি আবু মোতালেব বলেন, জয়পুরহাট চিনিকলের দূষিত বর্জ্য শ্রীখালে আসায় আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে খালে ছেড়ে দেওয়া মাছ মারা যায়। বিষয়টি নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি।

আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, কিছুদিন আগেও শ্রীখাল ও তুলসীগঙ্গা নদীর পানি ভালো ছিল। জয়পুরহাট চিনিকলের পানিতে শ্রীখাল ও তুলসীগঙ্গা নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্য মিশ্রিত অপরিশোধিত পানি তুলশীগঙ্গা নদীর পানিতে মিশে গিয়ে পরিবেশ দূষণ করছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা অস্বীকার করেছেন চিনিকল ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন আকন্দ।

গত সোমবার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি জানান, পরিবেশ দূষণের জন্য চিনিকলের অপরিশোধিত বর্জ্য নিঃসৃত পানি এককভাবে দায়ী, এমন অভিযোগ সঠিক নয়। পানি শোধনাগার নির্মাণ না হলেও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বর্তমানে বর্জ্যসহ পানি চিনিকলের নিজস্ব ক্যানেলে নেওয়া হচ্ছে। তবে যন্ত্রপাতি ধোয়ার স্প্রে করা পানি শুধু বের করে দেওয়া হয়, সেগুলোই কেবল জেলার বিভিন্ন ড্রেন ও খাল বেয়ে নদীতে পড়ছে, তবে সেগুলো পরিবেশের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ নয়।

তিনি আরো বলেন, জয়পুরহাট চিনিকল ছাড়াও জেলায় কয়েক হাজার চালকল ও মুরগি খামার রয়েছে, যেগুলো থেকে ব্যবহার অনুপযোগী পানি বের হয়ে তুলশী গঙ্গার পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ দূষণ হলেও শুধু এককভাবে চিনিকলকে দায়ী করা দুঃখজনক।

তারপরও যেটুকু পানি নিঃসৃত হয়ে নদীতে পড়ছে, তা আগামী বছরে চিনিকল এলাকায় শোধনাগার নির্মাণ হলে এক ফোটা পানিও বাইরে যাবে না বলে আশ^স্ত করেন চিনিকলের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

এদিকে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, প্রশাসনের রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা ও বগুড়ার পরিবেশ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে তদন্ত করে একটি রিপোর্ট আমাকে দিয়েছে, তদন্ত রিপোর্টে পানি দূষণ চিনিকলের বর্জ্যরে মাধ্যমে হচ্ছে বলে তারা অবহিত করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্জ্য পানিতে ফেলতে তাদের নিষেধ করা হয়েছে, বর্জ্য শোধানাগার প্রকল্পের জন্য ৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, কিছু টাকা তারা পেয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই সমস্যা থাকবে না বলেও তিনি জানান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close