গাজীপুর প্রতিনিধি

  ২০ অক্টোবর, ২০১৯

ভাওয়াল রাজবাড়ী : দিনে একরূপ, রাতে ভিন্ন

এখনো প্রায় অক্ষত রয়েছে গাজীপুর জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র জয়দেবপুরে অবস্থিত ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ী। বিশাল আকারের শতাব্দী প্রাচীন রাজবাড়ীটি টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। ভাওয়াল রাজবাড়ীর নির্মাণশৈলীও অনবদ্য। কালের সাক্ষী হয়ে থাকা রাজবাড়ীটি একটি ভালো পর্যটন স্পট হতে পারে। রাজবাড়ীটি এখন ব্যবহার করা হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা প্রশাসনসহ জেলার বিভিন্ন সরকারি অফিস ও আদালতপাড়া হিসেবে। ভাওয়াল রাজবাড়ীটিকে কর্ম দিবসগুলোতো থাকে এক রূপে আর ছুটির দিন এবং রাতে দেখা যায় ভিন্নরূপে। কর্ম দিবসে রাজবাড়ী থাকে কর্মব্যস্ত, থাকে হাজার হাজার লোকের সমাগম। আর ছুটির দিনে বা সন্ধ্যা রাতে আলো জলমলে রাজবাড়ীতে কিছু লোক সমাগম দেখা গেলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় এক রকম ভূতুড়ে পরিবেশ। এই রাজবাড়ী মনভরে দেখার ইচ্ছা থাকলে যেকোনো ছুটির দিন আসাই ভালো।

ওই রাজবাড়ীটি ঘিরে জড়িয়ে আছে অসংখ্য কাহিনি ও কিংবদন্তি। এর অন্যতম কাহিনি হলো ভাওয়াল পরগনার মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর ‘কথিত মৃত্যু’র ১২ বছর পর সন্ন্যাসবেশে ফিরে আসার গল্প। অবিকল মেজকুমারের মতো দেখতে সন্ন্যাসী জয়দেবপুরে এলে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক লোক আশপাশের এলাকা থেকে তাকে দেখতে আসেন। মেজকুমার জাত সন্ন্যাসীর মতো ছিলেন নির্বিকার। পক্ষান্তরে রাজবাড়ীর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মেজকুমারের স্ত্রী এবং স্ত্রী ভাই সঙ্গতকারণেই ব্যাপারটি সহজভাবে নেননি। তারা সন্ন্যাসীকে মেজকুমার বলে স্বীকার করেনি। কিন্তু উৎসাহী জনতা মেজকুমারের স্বীকৃতির জন্য প্রচন্ড সামাজিক চাপ সৃষ্টি করেন। ফলশ্রুতিতে ‘সন্ন্যাসী-মেজকুমার’ ইস্যুটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ভাওয়াল রাজার এভাবে ফিরে আসার গল্পটি নাটক থিয়েটারের কল্প কাহিনিকেও হার মানায়। ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা’টি তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পত্রপত্রিকায় মামলাটির শুনানি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। অনেক সংবাদপত্রই বিশেষ বুলেটিন বের করে। নির্মিত হয় দেশে-বিদেশে সিনেমা, নাটক।

সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রাজবাড়ীটি প্রায় ৫ একর জায়গার ওপর এটি নির্মিত। এর পশ্চিম পাশেই রয়েছে বিশাল দিঘি এবং সামনে বিশাল সমতল মাঠ। জয়দেবপুর-রাজবাড়ী সড়কের রাস্তার উত্তরপাশে রাজবাড়ী আর দক্ষিণপাশে রাজবাড়ী মাঠ। রাজবাড়ির সীমানা প্রাচীর বেশ উঁচু, কারুকার্য খচিত, দেখে মুগ্ধ হবেন যে কেউ।

মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দফতর হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। সাবেক জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর রাজবাড়ীর প্রবেশদ্বারে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেছেন। এর নির্মাতা ভাস্কর শিল্পী কুয়াশা বিন্দু। এতে রাজবাড়ী ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

প্রধান ফটক থেকে প্রায় অর্ধবৃত্তাকারের দুটো পথের যেকোনো একটা ধরে অগ্রসর হলেই মূল রাজপ্রাসাদ। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ভাওয়াল রাজবাড়ীটি মূলত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, ৩৬৩টি কক্ষ, দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট এবং দ্বিতল। বিশালাকৃতির রাজবাড়ীটির বিভিন্ন অংশের রয়েছে পৃথক পৃথক নাম। যেমনÑ বড় দালান, রাজ বিলাস, তারাবতী, পুরানবাড়ী, নাটমন্দির, হাওয়া মহল, পদ্মনাভ ইত্যাদি। রাজবাড়ীর সামনের অংশ নাম বড় দালান। এর নিচতলায় প্রশস্ত বারান্দা, তিনটি কক্ষ রয়েছে। নিচতলা থেকে ওপরের তলায় যাওয়ার রয়েছে ভাওয়ালের ঐতিহ্যবাহী শাল কাঠের সিঁড়ি। ওপরের তলায় রয়েছে একটি বড় হল ঘর এবং দুই পাশে দুটি কক্ষ। বড় দালান এখন গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বড় দালানের পেছনে (উত্তর পাশে) রয়েছে একটি খোলা প্রাঙ্গণ, এটি নাটমন্দির হিসেবে পরিচিত। এর পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছিল আবাসনের জন্য নির্মিত বারান্দাযুক্ত কক্ষ। নাট মন্দিরের উত্তর পাশের প্রাসাদগুলো পুরানবাড়ী নামে পরিচিত। মধ্যপশ্চিমাংশে রাজদিঘি সংলগ্ন দ্বিতল অংশের নাম ‘রাজ বিলাস’, নিচে রাজার বিশ্রামের কক্ষকে ‘হাওয়া মহল’, মধ্য-দক্ষিণ দিকে উন্মুক্ত কক্ষের নাম ‘পদ্মনাভ’, মধ্য-পশ্চিমে দোতলায় ‘রানী মহল’।

ভাওয়াল রাজবাড়ীর দরজা জানালা এবং অধিকাংশ সিঁড়ি এবং বারান্দার বেষ্টনীগুলো ভাওয়ালের ঐতিহ্যবাহী শাল কাঠের তৈরি। বড় দালান সংলগ্ন (পূর্বপাশে) রাজা কালী নারায়ণ রায়ের নিঃসন্তান ভগিনী কৃপাময়ী দেবীর বাড়ি (ট্রেজারি)। এছাড়া রাজবাড়ীর পূর্বপাশে ম্যানেজারের অফিস (বর্তমানে জয়দেবপুর সরকারি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়), পশ্চিমপাশে দেওয়ান খানা (রানী বিলাসমণি সরকারি উচ্চবালক বিদ্যালয়), রাজদিঘির পশ্চিমপাড়ে খাসমহল ছিল (ডা. আশু বাবুর বাড়ি)।

এর মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে একেবারে পেছনে যেতে হলে হাঁটতে হবে অনেকটা পথ, পেরুতে হবে অনেক কোঠা আর বারান্দা। ক্ষণে ক্ষণে চোখ আটকে যাবে বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শনে। বিশাল এ রাজপ্রাসাদটির বিশালত্ব দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আবার অনেকেই রাজবাড়ীতে ঢুকে গোলক ধাঁধায় পড়ে যেতে পারেন। কারণ এর গলি-উপগলি দিয়ে একবার হেঁটে গিয়ে নতুন যে কারোর পক্ষে পুনরায় সেগুলো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। মাত্র ৫ একর জমির ওপর নির্মিত এ রাজবাড়ীর প্রতিটি স্থানে প্রতিটি কক্ষে ঘুরে দেখতে সারা দিন লেগে যেতে পারে।

জানা গেছে, ভাওয়াল পরগনার এক সময় শাসন করতেন গাজী বংশের শাসকরা। ১৭৩৬ সালে গাজী বংশের শাসক দৌলত গাজী পদব্রজে হজব্রত পালন করতে গিয়ে পথিমধ্যে মারা যান। ১৭৩৮ সালে তার দেওয়ান বলরাম রায় নিজ নামে জমিদারি বন্দোবস্ত নেন। ওই বংশের জমিদার গোলাক নারায়ণ রায় ভাওয়ালের রাজবাড়ীটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এদিকে ভাওয়ালের জমিদারির সাত আনার মালিক পাশের গাছার জমিদার কালী প্রসন্ন রায় চৌধুরীর পুত্র কালী কিশোর রায় চৌধুরী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে নীলকর জে পি ওয়াইজের কাছে বিক্রি করেন। গোলাক নারায়ণের ছেলে কালী নারায়ণ রায় চৌধুরী জমিদারির ওই সাত আনা ক্রয় করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি রাজা উপাধি লাভ করেন। তার আমলে ভাওয়াল রাজবাড়ী, রাজদিঘি খনন সমাপ্ত করেন। কালী নারায়ণের পুত্র রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এই জমিদারির আরো বিস্তৃতি ঘটান। এই সময় ভাওয়ালর জমিদারি ঢাকা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এস্টেটের মৌজা সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৭৪টি। জমির পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ৯১৬ দশমিক ৩০ একর। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বনভূমি ছিল।

রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর ছিল তিন পুত্রসন্তান। তারা হলেন রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। ১৯০১ সালে রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যু হয়। এই সময় তার তিনপুত্রই ছিলেন নাবালক। সে কারণে জমিদারি বেঙ্গল গভর্মেন্ট ভাওয়াল এস্টেট অধীনে চলে যায়। পরে রানী বিলাসমণির বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে রিট করন। কোর্ট রানীর পক্ষে রায় দেন। ১৯০৭ সালে রানী বিলাসমণি মারা যান। এর আগে তিনি তার মধ্যম পুত্র রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর কাছে জমিদারি অর্পণ করেন। যিনি ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা হিসেবে অধিক পরিচিত।

কিভাবে যাবেন : দেশের যেকোনো স্থান থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে শিববাড়ী মোড়। সেখান থেকে জয়দেবপুর-রাজাবাড়ী সড়ক হয়ে পূর্ব দিকে কিছু দূর (আধা কিলোমিটার) অগ্রসর হলে এ বাজবাড়ীটি অবস্থান। আর ট্রেনে নামতে হবে জয়দেবপুর জংশনে। একইভাবে যাওয়া যায় রাজবাড়ীতে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close